advertisement
advertisement
advertisement

৬০ কোটি টাকার প্রকল্পে ব্যয় বাড়ছে আরও ৬৫ কোটি

রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার নির্মাণে পরিবর্তন হচ্ছে নকশা

জিয়াউল গনি সেলিম,রাজশাহী
২৭ নভেম্বর ২০২২ ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২২ ১০:৪২ এএম
রাজশাহীর তালাইমারী মোড়ে চলছে বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের নির্মাণকাজ -আমাদের সময়
advertisement

মহানগরীর তালাইমারী মোড়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু স্কয়ার নির্মাণে ২০১৭ সালে প্রকল্প গ্রহণ করে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ৫৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা। প্রকল্প মেয়াদ ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। ১.৪২ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু স্কয়ারটির বেজমেন্টের মধ্যে গাড়ি পার্কিং, আর্ট গ্যালারি ও জলধারাবেষ্টিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরি করা হবে। থাকবে প্রশ^স্ত গ্রাউন্ড ফ্লোর, যেখানে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং এবং ডিজিটাল স্ক্রিনযুক্ত স্থায়ী আর্ট গ্যালারি ও

জাদুঘর। ফার্স্ট ফ্লোরের মধ্যে আধুনিক রেস্তোরাঁ, দৃষ্টিনন্দন ল্যান্ডস্কেপ, উন্মুক্ত স্থানে বসা এবং সুস্থধারার বিনোদনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখারও পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ তো শেষ হয়ই-নি, উল্টো পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা পরিবর্তন করায় এর ব্যয় এখন দাঁড়িয়েছে ১২৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যেই প্রকল্পটির নকশা তৈরি ও সংশোধনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিজেদের দুই কোটি টাকা ফি বাড়িয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছে। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবটি প্রজেক্ট ইভ্যালুয়েশন কমিটি (পিইসি) থেকে ছাড় পেয়ে গেছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পেলেই তা অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকে উঠবে।

advertisement

আরডিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ‘সাতত্য আর্কিটেকচার ফর গ্রিন লিভিং’ নামের একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের দেওয়া নকশা চূড়ান্ত করা হয়। সেই সময় নকশার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে পরিশোধ করা হয় দুই কোটি টাকা। তবে নানা জটিলতায় ২০১৮ সালে প্রকল্পটি পাস হয়। অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু কাজের মাঝপথে এসে প্রকল্পটির নকশায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ফলে নকশা সংশোধনের পর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫ কোটি টাকায়। তবে প্রকল্পটির খরচ বাড়ার যৌক্তিকতা যাচাইয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়। ওই কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এই ব্যয় বৃদ্ধিকে ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছে। এর পর গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পিইসির সভায়ও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত সংশোধনী পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রায় প্রত্যেক খাতে ব্যয় বাড়ছে। কোনো কোনো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে দ্বিগুণ ব্যয় বাড়ানোর। অঙ্গভিত্তিক তুলনামূলক ব্যয়ের বিবরণীতে দেখা গেছে, মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে রাজশাহী-ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের খরচ ছিল পাঁচ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে এই খরচ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। জ্বালানি খাতে খরচ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে আড়াই লাখ টাকার। স্টেশনারিতে খরচ দুই লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা করার প্রস্তাব এসেছে। এ ছাড়া লাইব্রেরির বইয়ের জন্য পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে পাঁচ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার প্রস্তাব রয়েছে। আপ্যায়ন খাতে মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই লাখ টাকা। তবে প্রস্তাবিত প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে সেই ব্যয় কমিয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। নিয়মিত শ্রমিক খরচ কমিয়ে করা হয়েছে এক লাখ টাকা।

advertisement

কম্পিউটার এবং কম্পিউটার যন্ত্রাংশ কেনার জন্য প্রথমে অনুমোদন ছিল ১০ লাখ টাকা। সংশোধনী প্রস্তাবে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া সম্মানী ভাতা দুই লাখ থেকে বেড়ে সাত লাখ টাকা, অন্যান্য খাতে (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ড্রাফটিং, প্রিন্টিং, ইউটিলিটি সংযোগ ফি ইত্যাদি) পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ এবং রাজশাহী বিভাগের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহ এবং বঙ্গবন্ধু ছবি অঙ্কনের জন্য মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে টাকা বরাদ্দ রাখা ছিল না। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এ খাতে ৫০ লাখ ব্যয় টাকা ধরা হয়েছে। কর্মকর্তাদের জন্য আছে, বিদেশ ভ্রমণেরও সুযোগ। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান আরডিএর ৪-৫ জন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং প্ল্যানিং কমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল অচিরেই বিদেশ সফর করবেন বলে জানা গেছে। এ খাতে ব্যয় আগে ধরা হয়েছিল ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু এখন সেই ব্যয় কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব আছে।

জানা গেছে, মূল অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী ডিজাইন ও এক বছর সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘সাতত্য আর্কিটেকচার নিয়েছে দুই কোটি টাকা। তবে প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ডিজাইন ও ৪২ মাস সুপারভিশনের জন্য তারা আরও এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা চায়। তিনটি লিফট কেনার কথা ছিল এক কোটি ৬৬ লাখ টাকায়। তবে এবার পাঁচটি লিফট কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তিন কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচে। এয়ারকুলার ভিআরএফ ১৪টি ও ৭টি এএইইউ (৪২ টন) কেনার জন্য দাম ধরা হয়েছিল ২৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। তবে এখন তা ২৬২ টনের এয়ারকুলারের জন্য দাম প্রস্তাব করা হয়েছে তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা। একটি মোটরসাইকেলের (১৫০ সিসি) জন্য এক হাজার টাকা দাম কমিয়ে এক লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং দুই লাখ ৯৯ হাজার টাকার একটি ফটোকপিয়ার মেশিনের দাম এক হাজার টাকা কমানো প্রস্তাব করা হয়েছে। আসবাবপত্র কেনাকাটায় অনুমোদন ছিল ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু আসবাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দামও দুই কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি ইলেকট্রিক সাবস্টেশনের (৩০০ কেভিএ) জন্য অনুমোদন ছিল ১০ লাখ ৩২ হাজার টাকা। তবে ক্যাপাসিটি বাড়িয়ে ৫০০ কেভিএর জন্য খরচের প্রস্তাব রয়েছে ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। জেনারেটর ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাপনা খাতের খরচও বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। সব মিলিয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কারণেই ৫৯ কোটি ২৮ লাখ টাকার প্রকল্প এখন আরডিএ নিয়ে যেতে চায় ১২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকায়।

প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন ও খরচ দ্বিগুণ বাড়ার বিষয়ে জানতে সাতত্য আর্কিটেকচার ফর গ্রিন লিভিংয়ের প্রধান নির্বাহী জাহিদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, স্থপতি রফিক আজম এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন। তবে তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন।

একই প্রসঙ্গে আরডিএর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামান বলেন, কাজ শুরুর পরও স্থপতি নকশা সংশোধন করেছেন। পুরো ডিজাইনেই ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। থ্রিডি প্রজেক্টশনসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির দামি দামি নানা সরঞ্জাম কেনা হবে। এ কারণে খরচও বেড়েছে।

আরডিএ চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেন বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দেশে-বিদেশে খ্যাতি রয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে তাদের জমা দেওয়া ডিজাইনটি মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করেছিল। তবে মাঝে স্থপতি আবার নতুন নতুন চমৎকার কিছু আইডিয়া সংযোজন করে নকশা আরও সমৃদ্ধ করেছেন। এ কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেছে। মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে ব্যয় বাড়ার যৌক্তিকতাও যাচাই করেছে। আশা করছি, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পেয়ে গেলে সংশোধন প্রস্তাবটি একনেকে উঠবে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের নির্মাণ সম্পন্ন হবে।