লালকার্ড দেখেও যে খুশি হওয়া যায় ফুটবলে এমন ঘটনা বিরল। কাতার বিশ্বকাপের আগে সবশেষ ২০১৪ সালে হাত দিয়ে ঘানার নিশ্চিত গোল ঠেকিয়ে মাঠ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন উরুগুয়ের স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ। সাড়ে আট বছর পর তেমন একজনকে দেখা গেল, যিনি লালকার্ড দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।
তিনি ভিনসেন্ট আবুবকর। ক্যামেরুন অধিনায়ক। তার অপরাধ জার্সি খুলে ফেলা। সেটি আবার ম্যাচের অন্তিম প্রহরে; জয়সূচক গোলের পর। আসলে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের জাল কাঁপানোর পর জার্সি খুলে আবুবকর এমনই বুনো উল্লাস করলেন, যা লঙ্ঘন করেছে ফুটবলীয় রীতি।
অবধারিতভাবেই ক্যামেরুন অধিনায়ককে লালকার্ড দেখান রেফারি। মাঠ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পরও দারুণ খুশি আবুবকর। তার এই উচ্ছ্বাস শিরোপাপ্রত্যাশী ব্রাজিলকে হারিয়ে দেওয়ার। প্রথমবারের মতো লাতিন আমেরিকানদের বিপক্ষে জয়খরা কাটানোর; এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা অঘটন ঘটানোর। সেলেকাওদের ক্যামেরুন শিকারে পরিণত করেছে ১-০ গোলে।
শুক্রবার রাতে লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে অঘটনের শিকার হওয়ার পরও ‘জি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ব্রাজিল। নকআউট পর্বে সেলেকাওদের সঙ্গী হয়েছে সুইজারল্যান্ড। একই সময়ে গ্রুপের অন্য ম্যাচে সার্বিয়াকে ৩-২ গোলে হারিয়েছেন শাকিরি-জাকারা। তারা হয়েছেন গ্রুপ রানার্সআপ। কিন্তু ঐতিহাসিক জয়ের পরও অশ্রুসিক্ত বিদায় নিতে হয়েছে ক্যামেরুনকে। তাদের বিদায় অবশ্য আগেই নিশ্চিত হয়েছে। তিন ম্যাচে ৪ পয়েন্ট তাদের। এই ম্যাচে আফ্রিকান দলটির হারানোর কিছু ছিল না; তবে পাওয়ার ছিল। সেটিই তারা পেয়ে গেল। এবারের কাতার বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বের শেষ অঘটনটি ক্যামেরুনই ঘটাল।
গোলের জন্য শুরু থেকে মরিয়া হয়ে ওঠে ব্রাজিল। সেই সুযোগটা দ্বিতীয়ার্ধে যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে নিয়েছে ক্যামেরুন। প্রতিআক্রমণে এনগোম এমবেকালির মাপা ক্রসে মাথা ছুঁয়ে দুর্দান্ত গোল করে আবুবকরের ভোঁ-দৌড়। উদযাপনের সময় আবেগের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি, যার খেসারত দিতে হয়েছে লালকার্ড দেখে।
আবুবকরের উত্থানটা অবশ্য অনেক আগেই হয়েছে। ২০১৭ সালে ক্যামেরুনের আফ্রিকান নেশনস কাপ জয়ের অন্যতম সারথি ছিলেন তিনি। ৩০ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার গত বছর এ টুর্নামেন্টের গোল্ডেন বুট জিতেছেন। ২০১০ সালে জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেক তার। খেলেছেন ইউরোপের নামকরা কয়েকটি ক্লাবে। সর্বোচ্চ অর্ধযুগ তার কেটেছে পোর্তোর হয়ে। দুটি পর্তুগিজ লিগসহ মোট চারটি শিরোপা জেতেন তিনি ক্লাবটির জার্সিতে। আবুবকরের পরিবার খুব সমৃদ্ধ ছিল না। এডওয়ার্ড ও মাওবেলের সংসারে আট সন্তানের একজন তিনি। ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছে বাবা-মায়ের কাছ থেকেই। তারা দুজনই ছিলেন অপেশাদার ফুটবলার। এই দম্পতি নিজেদের অধরা স্বপ্ন পূরণ করেছেন ছেলেকে দিয়ে। আবুবকরের একজন সফল পেশাদার ফুটবলার হয়ে ওঠার পেছনে তাদের ইচ্ছশক্তিই বড় অনুঘটক ছিল। সেই আবুবকর এখন ক্যামেরুনের জাতীয় নায়ক হয়ে উঠেছেন। অনেকেই তার মধ্যে ছায়া দেখেন দেশটির ফুটবলে সবচেয়ে বড় তারকা স্যামুয়েল ইতোর। উত্তরসূরির গোলটা গ্যালারিতে বসেই দেখেছেন এই কিংবদন্তি। ম্যাচশেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে নেমে আবুবকরের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন ইতো। পরশু ক্যামেরুনের হয়ে ৯৩তম ম্যাচে ৩৪তম গোলটি করেছেন আবুবকর। সেই গোলের ওপর দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক জয়। এমন একজনকে যে লালকার্ড দেখাতে হয়েছে, সেটির জন্য খোদ রেফারি ইসমাইল এলফাথকে অনুশোচনায় ভুগতে হয়েছে। ম্যাচ শেষে তিনি বলেছেন, ‘আমি দুঃখিত (আবুবকরকে লালকার্ড দেখিয়ে)। কিন্তু আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।’