advertisement
advertisement
advertisement

পথে পথে ছড়িয়ে ছিল নির্যাতিতদের লাশ

মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী

লাবণ্য লিপি
৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ এএম | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:৫৩ এএম
advertisement

১৯৭১ সাল। দেশে তখন ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। পাকবাহিনীর নির্মমতা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। তারা হত্যা করছে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ। রেহাই পায়নি নারী, শিশু, বৃদ্ধও। এ নির্যাতন প্রতিরোধে জীবনপণ লড়ে যাচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনীর নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, যে কোনো মানুষের পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন ছিল। বয়সে যারা তরুণ তাদের পক্ষে যুদ্ধে না যাওয়াটাই তখন অস্বাভাবিক ছিল। যারা কোনোদিন হয়তো পাখিও মারেনি তারাও হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র, মা-মাটি আর দেশকে রক্ষা করার জন্য। মৌলভীবাজারের নূরজাহান চা বাগানের কুমার নায়েক একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি প্রথমে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন শরণার্থী হিসেবে। কিন্তু পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে স্থির থাকতে পারেননি। যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে এখনো তিনি শিউরে ওঠেন।

দিনের তখন প্রথমভাগ। কড়া রোদ উঠে গেছে। নূরজাহান বাগানের নাচঘরের সামনেই গাড়ি থেকে নেমে আমরা খোঁজ নিতে চেষ্টা করি কুমার নায়েকের বাড়ির। সরু এবড়োখেবড়ো রাস্তার দুই পাশে চা শ্র্রমিকদের থাকার ঘর। বাইরে থেকেও বোঝা যায় সেসব ঘরের আকার-আয়তন। রাস্তায় কোথাও কোথাও কাদাপানি জমে আছে। অনেকটা পথ গিয়ে আমরা খুঁজে পেলাম কুমার নায়েকের বাসা। সেখানে গিয়েও আরেক বিপত্তি। উনি বাড়িতে নেই। ছাগলের জন্য ঘাস কেটে আনতে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি এলেন। বয়সের ভারে খানিকটা নুয়ে পড়েছেন। আমাদের সামনের চেয়ারে বসলেন। জানতে চাইলাম তার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ঘটনা। বললেন, আমরা তখন থাকতাম উদনাছড়া চা বাগানে। আমার মা-বাবা বাগানে কাজ করতেন। আমাদের বাগানের আশপাশে তখন পাকসেনারা নির্যাতন চালাচ্ছে। নানা রকম খবর কানে আসছে। পাকবাহিনীর নির্যাতনের খবর শুনে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা যায় না। তখন একদিন নাগাবাড়ির হরিতাঁতী আর নিতাই বুনার্জি বলল, চল আমরা ভারতে চইলা যাই! জান বাঁচাইতে হইলে এখান থেকে চইলা যাইতে হইব। তখন আমরা কয়েক ঘর পরিবার-পরিজন লইয়া আসাম দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি আশ্রয় নেওয়ার জন্য। কিন্তু যাওয়ার সময় পথে যা দেখেছি, তাতে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। যে দিকেই তাকিয়েছি পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের চিহ্নই দেখেছি। ওরা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় পড়েছিল অনেক মানুষের লাশ। লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ওরা মানুষ মেরেছে। ছোট ছোট শিশুদের আছাড় দিয়ে মেরেছে। ওদের মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে গেছে। পড়ে ছিল বয়স্ক মানুষের লাশ। এসব দেখে ভারতে গিয়েও কিছুতেই স্থির থাকতে পারি নাই। ভারতে গিয়ে আমরা তো শরণার্থী হইলাম। কিন্তু সেখানে ছিল ভয়াবহ পরিবেশ। এত মানুষ! তাদের নানা রকম রোগবালাই। তাদের গায়ের কাপড়ের অভাব, খাবারের অভাব। আরও কত যে সমস্যা। দেখে খুব কষ্ট হতো। খালি মনে হইত, পাকবাহিনী আমাদের ওপর অত্যাচার করছে, আমাদের শরণার্থী বানাইছে। এসব দেখে চুপ করে বসে থাকা যায়! মাত্র ৩-৪ দিন ছিলাম শরণার্থী ক্যাম্পে। তখন দেশ থেকে আসে আতাফুর। সে আমাদের বলল, যুদ্ধে যাইতে হইব। এভাবে তো ওদের হাতে মার খাওয়া যায় না। দেশের সব জুয়ান পোলাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিছে। তোমাদেরও যাইতে হইব। আমি, হরিতাঁতীসহ আমরা কয়েকজন তখনই রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের কথা হইল মরলে মরব। কিন্তু পড়ে পড়ে মার খাব না। তা ছাড়া শেখ সাহেব তো বলছেই সবাইরে যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়তে। যার যা আছে তাই নিয়াই যুদ্ধ করতে বলছেন। আমার কিছুই নাই। কিন্তু গায়ে জোর তো আছে। আমিও যুদ্ধে যাব স্থির করলাম।

advertisement

আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো আগরতলার, ত্রিপুরার অমরপুরে ক্যাম্পে। ওখানেই আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তখন আর হাতে সময়ও নাই অনেক দিন ধরে ট্রেনিং দেওয়ার। শুরুর দিকে শুনছি অনেক দিন মানে এক মাস ধরে ট্রেনিং দিয়েছে। কিন্তু আমাদের মাত্র ১০ দিন ট্রেনিং দিয়েই দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের কমান্ডার ছিলেন আবু তাহের সাহেব ও আজাদ সাহেব। শর্ট ট্রেনিংয়ে আমাদের শিখানো হয়েছিল এলএমজি চালানো আর হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া। আমাদের অপেক্ষা করতে বলা হলো। যে কোনো সময় ডাক আসবে। তখন যেতে হবে। ১০ দিন পরই আমরা আগরতলা থেকে আসাম হয়ে দেশে ঢুকলাম। আমাদের সঙ্গে আরও ছিল লাখাইছড়ার রবি লাল কেউট, অর্জুন বুনার্জি। আবারও পাকসেনাদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে দেখতেই ফিরলাম আমরা। আশপাশের বাড়িঘর পোড়া, ভাঙা। খাল-বিলের পাশ থেকে লাশপচা গন্ধ আসছে। তখন তো মনের জোর বেড়েছে। ইচ্ছা করছিল তখনই কাউকে পাইলে গুলি কইরা উড়াইয়া দিব। কিন্তু দেশে ঢুকে শুনলাম যুদ্ধ শেষ। পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। ওরা এখন পেছনে হটছে। কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হইল। কারণ তখনো দেশ শত্রুমুক্ত হয়নি। নানান জায়গা থেকে নানান খবর আসে। আমরা আমাদের এলাকা পাহারা দিতাম। কোনো রাজাকারের খবর পাইলে তারে ধইরা পিটাইতাম। তখন রাজাকাররাও গা ঢাকা দিতেছিল। চারপাশে লুট হচ্ছিল। আমরা রাতের বেলা পালা করে করে মানুষের বাড়িঘর পাহারা দিতাম। তার কয়েক দিন পর আমাদের অস্ত্র জমা দিতে বলা হলো। আমরা অস্ত্র জমা দিয়ে আসলাম। মনে কষ্ট পাইলাম, ট্রেনিং নিয়াও একটা পাকিকে (পাকিস্তানি) মারতে পারলাম না!

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হইল আরেক কষ্ট। সংসারে খুব অভাব। খাওয়ার মানুষ অনেক। কিন্তু রোজগার কম। আমার মা-বাবা বাগানে কাজ করত। তাদের আয়ের ওপর আমাদের এত বড় সংসার চলত। আমাদের খাওয়া-পড়ারও খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার এক ভাগনে তখন বলল, নূরজাহান চা বাগানে চলে আসতে। এই বাগানে এসে আমি সর্দারের কাজ নিলাম। তার কিছুদিন পরে পাইলাম সরকারি চিঠি। মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট পাইলাম। তবে এখন আমি ভাতা পাই। আমার বয়স হইছে। ছেলে বাগানে সর্দারের কাজ করে। সংসার বড় হইছে। এই ভাতায় আর ছেলের রোজগারে সংসার চলে না। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা শুনছি রেশন পায়, ঘর পায়। তারপর একটা ঘর, আর একটা শূন্যভিটা দেখিয়ে বললেন, আমার আরেকটা ঘর তোলারও সঙ্গতি নাই। এখনও আমি যা পারি কাজ করি। গরু-ছাগলের জন্য ঘাস কেটে আনি, রান্নার লাগড়ি জোগাড় করি। তবু এটা আমার নিজের দেশ। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই দেশ। এটাই শান্তি।

advertisement