টাঙ্গাইল শহরের বধ্যভূমি
‘টাঙ্গাইল জেলা সদরের পানির ট্যাংক বধ্যভূমিতে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গুলি করার জন্য লাইনেও দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। যখন আমাকে গুলি করবে, তখন হানাদার ওয়ারেন্ট অফিসারের ওয়্যারলেসে একটি মেসেজ আসে। সেটি পেয়ে গুলি না করে সেই অফিসার আমকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি সিএনএফ, ভয়েস অব আমেরিকা এবং বিবিসির সাংবাদিকরা। ওখানে পাকিস্তানি একজন কর্নেল ছিলেন। সাংবাদিকরা আমার সাক্ষৎকার নিলেন। সাংবাদিকরা থাকার কারণে হয়তো আমাকে মারেনি।’
কথাগুলো টাঙ্গাইলে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সাক্ষী টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার জহুরুল হক ডিপটির। জেলায় একাত্তরের বধ্যভূমি কোথায়, কতটি- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এভাবেই সদর পানির ট্যাংক বধ্যভূমির বর্ণনা দেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্মৃতি রোমন্থন করেন রক্তঝরা একাত্তরের দিনগুলোর।
টাঙ্গাইল জেলায় একাত্তরের বধ্যভূমি ঠিক কতটি, সে ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য স্থানীয় প্রশাসন কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছে নেই। কেউ বলছেন বধ্যভূমি ২০টির মতো, আবার কেউ বলছেন ৪০টির কাছাকাছি। আর জেলা প্রশাসন বলছে, টাঙ্গাইলের অনেকগুলো বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। আরও বধ্যভূমি চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার জহুরুল হক ডিপটির ভাষায়, টাঙ্গাইলে ২০টির মতো বধ্যভূমি আছে। জেলা সদর রোডে পানির ট্যাংক বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পাশে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের কাজ চলছে। বধ্যভূমির ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি তথ্য তার কাছে নেই।
টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ কয়েকটি বধ্যভূমির নাম উল্লেখ করেন। সেগুলো হচ্ছেÑ জেলা সদরে পানির ট্যাংক বধ্যভূমি, শহরের কলেজপাড়া কূপ বধ্যভূমি (বর্তমানে আর্টিজেন্স), বিসিক তারটিয়া ভাতকুড়া, নাগরপুর, মির্জাপুর, সখীপুর, ভূঞাপুর ও গোপালপুর বধ্যভূমি। তার মতে, জেলায় আরও বধ্যভূমি থাকতে পারে, সবগুলোর নাম তার মনে নেই।
এই দুই মুক্তিযোদ্ধার ভাষ্যমতে, টাঙ্গাইল জেলা সদরের সার্কিট হাউসটি পাক হানাদার বাহিনী জেলার মূল ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। সার্কিট হাউসের পাশে পানির ট্যাংকের পাশের জঙ্গলে বাঙালিদের হত্যা করে তারা লাশ ফেলত। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল জেলা হানাদারমুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বাঙালিকে পাকিস্তানি হানাদাররা এ বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখে। ক্যাম্পের পাশে বন্দিশালা ও নির্যাতন কেন্দ্রে অনেক নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক নারী-পুরুষদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে পানির ট্যাংকের পাশে ফেলে রাখা হতো। কিন্তু এই বধ্যভূমিতে শহীদ অনেকেরই নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।
একাত্তরের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী টাঙ্গাইল বিসিক তারটিয়া পালপাড়ার দিলিপ কুমার পাল বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমি অনেক ছোট ছিলাম। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে আমার বাবা, চাচা ও জেঠাতো ভাইকে আমার সামনে বন্দুকের নল দিয়ে পিটিয়ে কাঁধের হাড় ভেঙে দেয় এবং হত্যা করে হানাদাররা। দিলিপ কুমারের তথ্যমতে, তারটিয়া পালপাড়ায় গণকবর দেওয়া হয় ১০ জনকে। তারা হলেনÑ যোগেন্দ্র পালের ছেলে সুনীল পাল ও সুবল পাল, রংলাল পালের ছেলে কৃষ্ট পাল, মহেশ পালের ছেলে মতি পাল, রামপালের ছেলে মেগলাল পাল, মতিপালের ছেলে গৌর পাল, সুবল পালের ছেলে ভজন পাল, ওমেশ পালের ছেলে কানাই পাল, ভাতকৃড়ার শিশিরের ছেলে রশিদ খান এবং নিতাই বসাকের ছেলে বিজয় বসাক।
টাঙ্গাইল সদরের করটিয়ার মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার সোলায়মান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালে জুলাইয়ের মাঝামাঝি অথবা শেষের দিকে অতর্কিতে পাক হানাদাররা এসে এলাকার হিন্দু-মুসলমান মিলে প্রায় ৪০ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। শিশুদেরকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে গুরুতর জখম করে। তারা কিছুদিন বেঁচেছিল, পরে মারা যায়। সোলায়মান আরও বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা চাইÑ সরকারের মাধ্যমে বধ্যভূমি, বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ করা হোক, এটির জন্য আমরা সময়ে সময়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। টাঙ্গাইল সদরসহ ১২ উপজেলায় ৪০টির মতো বধ্যভূমি আছে। একমাত্র টাঙ্গাইল সদরে পানির ট্যাংক বধ্যভূমিটি পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাকিগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহম্মদ বলেন, সখিপুর উপজেলার (মুক্তিযুদ্ধের সময় থানা) বংশাই নদীর তীরের কালিয়ান গ্রাম। একাত্তরে আমি বিশেষ সেক্টর টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী ২ নম্বর কোম্পানির ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কালিয়ানের যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল কামুটিয়া যুদ্ধ থেকে। একাত্তরের ১৯ জুন কামুটিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। এটি পরিচালনা করেন বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। যুদ্ধ দুটি ইউনিটে ভাগ হয়ে পরিচালিত হয়। একটি ভাগের নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান খোকা বীরপ্রতীক। আরেক ভাগের নেতৃত্বে ছিলেন সখিপুরের আনসার উদ্দিন। বঙ্গবীরের নির্দেশে আমরা ২ নম্বর কোম্পানি রয়ে গেলাম কামুটিয়ায়। তিনি সখিপুর হেডকোয়ার্টারে চলে গেলেন। ১৯৭১ সালের ১ জুলাই ভোরে বাসাইল থেকে সোর্স মারফত জানতে পারি, পাকিস্তানি বাহিনী রাতে বাঔখোলা আদাযান হয়ে বাসাইল বাজার থেকে অন্তত ৮টি নৌকায় সম্ভাব্য ৮০ জন পাকসেনা বংশাই নদী দিয়ে কালিহাতী থানার বল্লা বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নৌকাগুলোর একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব প্রায় ৪০ গজ। আমরা কালিয়ান পাহাড়ের কাছাড়ায় শত্রুর দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু আমদের কাছে তেমন ভারী অস্ত্র ছিল না। একটি মাত্র চাইনিজ এলএমজিও, একটি মাত্র দুই ইঞ্চি মর্টার, বাকি সব ছিল রাইফেল। শত্রুর নৌকা আমাদের রেঞ্জের আওতায় আসামাত্র সহকারী কমান্ডার করপোরাল মো. সোহরাব হোসেন মর্টার ফায়ার করেন। আমরাও ফায়ার শুরু করি। জবাবে পাকসেনারা অনবরত গুলি বর্ষণ করতে থাকে। ওই দিন বেলা ১১টায় যুদ্ধ শুরু হয়। চলে প্রায় এক ঘণ্টা। পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাবে শেষ পর্যন্ত আমরা ডিফেন্স প্রত্যাহার করে চলে আসি। তখন পাক সেনারা কালিয়ান গ্রামের দুআনি পাড়া গ্রামের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। গ্রামের যাকে যেখানে পায় সেখানেই হত্যা করে। ওই দিন ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা বাসাইল থানা খাটরা গ্রামের ঈমান আলী পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। শহীদ ১৮ জনের স্মরণে বর্তমানে কালিয়ান উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে ।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বলেন, সরকার বধ্যভূমি খুঁজে খুঁজে বের করে সংরক্ষরণের উদ্যোগ নিয়েছে। টাঙ্গাইল এখন পর্যন্ত অনেক বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সম্মিলিতভাবে এসব বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষরণ করা হচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলায় আর কোথায় কোথায় বধ্যভূমি আছে, সেগুলো খুঁজে পাওয়ার জন্য আরও গবেষণা ও অনুসন্ধান দরকার। সেই লক্ষ্যে আমরা টাঙ্গাইল জেলায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কেন্দ্র টাঙ্গাইল স্থাপন করতে যাচ্ছি। কাজ সম্পন্ন হলে এই স্মৃতি কেন্দ্রের পক্ষ থেকে গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে বধ্যভূমি খুঁজে বের করা হবে। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের চত্বরের কাছে যে পানির ট্যাংক, সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করে ফেলে দিত পাকবাহিনী। ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এটি সংস্কার করা হয়েছিল। ২০২০ সালে এটি পুনরায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংস্কার করা হয়। প্রতিবছর ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করি এই বধ্যভূমির শহীদদের প্রতি। পানির ট্যাংক বধ্যভূমির মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির ত্যাগের ইতিহাসকে সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি।