advertisement
advertisement
advertisement

দেখে এলাম ফেরাউনের লাশ

মিশরের ডায়েরি

আরিফুজ্জামান মামুন,মিশর থেকে ফিরে
৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ এএম | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:৫৭ এএম
মিশরের জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ফেরাউনের (দ্বিতীয় রামেসিস) মমি ষ সংগৃহীত
advertisement

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কাভার করতে মিসর যাব। দেশটির ঢাকার দূতাবাসে ভিসার আবেদন করলাম। ভিসা যে পাব সেটি অনুমিতই ছিল। কায়রো উড়াল দেওয়ার আগেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম কাজের পাশাপাশি কোন কোন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করব। কারণ প্রাচীন সভ্যতা ও ইসলামি নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত মিশর। এখানে আছে বিখ্যাত নীলনদ, পৃথিবীর সপ্তাশ্চার্যের পিরামিড, ফেরাউনের মৃতদেহ, কারুনের ধ্বংসাবশেষ, তুর পাহাড়, লোহিত সাগর, প্রাচীন ফারাও রাজা বাদশাহদের প্রত্নতত্ত্ব ভাস্কর্যের সম্ভার। আছে প্রাচীন সভ্যতা ও বিভিন্ন নবী রাসুলসংশ্লিষ্ট নানান নিদর্শন। এ ছাড়া রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন ও বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়।

মিশর পৌঁছে প্রথম দিনই ঠিক করলাম পিরামিড ও ফেরাউনের লাশ দেখতে যাব। ফেরাউন সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের ইয়ত্তা নেই। সকালের নাশতা খেয়ে বের হয়ে পড়লাম মিসরের নতুনভাবে তৈরি জাতীয় জাদুঘরের উদ্দেশে। সেখানে সংরক্ষিত আছে ফেরাউনের লাশ। জাদুঘরে ঢুকতে ২৪০ মিশরীয় পাউন্ড দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। ভেতরে প্রবেশের পর তথ্যকেন্দ্রের পাশে বিশাল ডিজিটাল বোর্ড। এখানে ছবি তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এ জন্য গুনতে হবে ৫০ মিশরীয় পাউন্ড। ডিজিটাল ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ বোধ না করায় আমি ছবি তুলিনি। পুরো জাদুঘর চত্বরটি নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা।

advertisement

নিরাপত্তার নানা বেড়াজাল পেরিয়ে অবশেষে আমরা ফেরাউনের লাশের কাছাকাছি চলে এলাম। এরপর ঢুকলাম লাশ সংরক্ষিত কামরায়। মনে মনে তখন কত চিন্তা। দেখতে কেমন ছিল ফেরাউন, কতটুকু উচ্চতা ইত্যাদি ইত্যাদি। বুকে অজানা এক ধাক্কা খেল। এতদিন যে ফেরাউন সম্পর্কে কত গল্প, কথা শুনে এসেছি, ইতিহাস বইয়ের পাতায় পড়েছি, সেই ফেরাউনের লাশের সামনে আমি। যে এক অজানা ভয় ছিল ঢোকার পর অবশ্য সেই ভয় কেটে গেল। কারণ আমার মতো আরও নানা দেশের শত শত মানুষ লাশ দেখছে।

স্বচ্ছ কাচের ভেতরে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে লাশটি। ঘরটিতে হালকা নীল রঙের আলো থাকায় পুরোটা স্পষ্ট না। তবে ফেরাউনের লাশ যে কাচের ভেতর সংরক্ষিত সেটি স্পষ্ট। আমাদের সমাজে ফেরাউনের ব্যাপারে নানান কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলে থাকেন ফেরাউন ১২০ ফিট লম্বা। আবার কথিত আছে ফেরাউন ৬০ ফিট লম্বা। আমি বেশ সময় নিয়ে ফেরাউনের লাশটি দেখলাম। মনে হলো লম্বায় ছয় থেকে সাত ফিট হবে। মুখের একটি অংশ অনেকটা বিকৃত হয়ে গেছে। নিথর দেহ। এককালের প্রতাপশালীর এমন নিথর দেহ দেখে মনে হলো, ক্ষমতা ও প্রভাব আসলেই চিরজীবন কারো থাকে না। চোখগুলোও কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে। চুলগুলো অবশ্য অনেকটা ভালো আছে। দীর্ঘ দেহে একধরনের সাদা বিশেষ ধরনের কাপড় পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে, সেটাও মনে হয় অনেক পুরনো। কাচের ওপর নাম লেখা দ্বিতীয় রামসিস।

advertisement

ফেরাউন ছিল মিসরের বাদশাহদের উপাধি আর মুসা আ. এর যুগের ফেরাউনের নাম ছিল দ্বিতীয় রামসিস। জীর্ণশীর্ণ দেহটি এখন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে মেডিসিন দিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজারের মতো পর্যটক লাশটি দেখতে আসেন। ভেতরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে তেমন কিছু আর করা যায়নি। ছবি উঠানো একেবারেই নিষেধ। প্রতিটি দর্শনার্থীই চেষ্টা করছেন ছবি উঠাতে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ অন্যকক্ষ থেকে সিসি ক্যামোরায় সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে এর ব্যত্যয়ও অনেক সময় ঘটে। ফেরাউনের লাশের আশপাশে প্রাচীন রাজা বাদশাহদের আরও কয়েকটি লাশ আছে। সেগুলোও দেখলাম। সব একই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা। দীর্ঘ এক ঘণ্টা পর আমি বেরিয়ে এলাম। মনে হলো কী যেন একটা শূন্যতা পূরণ হলো।

প্রসঙ্গত, আরবি শব্দ ফেরাউন। ইংরেজি ফারাও, বাংলা ফেরাউন। ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেশীয় রাজা মেনেসের নেতৃত্বে সারা মিসর ঐক্যবদ্ধ হলে ফারাও রাজবংশের সূচনা। প্রাচীন মিসরীয় সম্রাটের রাজকীয় উপাধি ফারাও বা ফেরাউন। প্রচলিত ফেরাউন বলতে দ্বিতীয় রামসিসকে (১২৭৯-১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বোঝায়। তিনি তুতেন খামেন, কাবুস ইত্যাদি পরিচয়ে কুখ্যাত। ইবনে কাসিরে ফেরাউনের পূর্ণ নাম হলো ওয়ালিদ ইবনে মুসাইয়্যিব ইবনে রাইয়্যান। এই পাপিষ্ঠের নাম পবিত্র কোরআনের ২৭ সুরায় ৭৪ বার আছে।

প্রাচীন মিসরের রাজধানী পেন্টাটিউক দ্বিতীয় রামসিস নামধারী ফেরাউনের আবাসস্থল। তার ছিল ১১১ পুত্র ও ৬৭ কন্যা। বর্ণিত আছে, একবার ফেরাউন দারুণ দুঃস্বপ্ন দেখে, ব্যাখ্যাকারীর মাধ্যমে জানতে পারে, বনি ইসরাইল গোত্রে জন্মগ্রহণকারী এক পুত্রসন্তানের নেতৃত্বে তার রাজত্বের অবসান ঘটবে। তখন ফেরাউন গুপ্তচর লাগিয়ে দেয়, যেন কোনো পুত্রশিশুর জন্ম না হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘ফেরাউন পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সে তার জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের এক শ্রেণিকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিল, যাদের পুত্রসন্তানকে সে জবাই করত ও নারীদের (ভোগের জন্য) জীবিত রাখত...। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ০৪)

এমন পরিবেশে হজরত মুসা (আ.)-এর জন্ম হয়। ক্ষমতার দাপট, ঔদ্ধত্যে বিভোর ফেরাউন নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক ‘রাব্বুল আলা’ ঘোষণা করে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘সে বলল, আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক বা রব। পরিণামে সে আল্লাহর ইহ-পারলৌকিক শাস্তিতে নিপতিত হলো। নিশ্চয়ই এর মধ্যে আছে ধর্মভীরুদের জন্য পরম শিক্ষা।’ (সুরা : নাজিয়াত, আয়াত : ২৪-২৬)

ফেরাউন ছয় হাজার কিবতি সেনা নিয়ে মুসা (আ.)-এর অনুসারীদের তাড়া করে লোহিত সাগরের তীরে নিয়ে আসে। তখনই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরাউনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো। আল্লাহ ঘোষণা করলেন, সুতরাং আমি তাকে ও তার বাহিনীকে ধরলাম এবং তাদের সাগরে নিক্ষেপ করলাম। (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৪০) অত্যাচারী ফেরাউনের পতন ও পরাজয় হয়। মুসা (আ.)-এর দুর্বল, অসহায় অনুসারীরা পেল মুক্তি-স্বাধীনতা। ইরশাদ হয়েছে, আমি বনি ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফেরাউন ও তার বাহিনী অত্যাচার ও সীমা লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। তারপর যখন সে ডুবে মরার উপক্রম হলো, তখন বলতে লাগল, আমি বিশ্বাস করলাম, বনি ইসরাইল যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।