advertisement
advertisement
advertisement

লক্ষ্মীপুর ও মুন্সীগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ

ষরক্তঝরা একাত্তর

মো. জহির উদ্দিন, লক্ষ্মীপুর ও নাদিম হোসাইন, মুন্সীগঞ্জ
৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ এএম | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৩:১৯ এএম
advertisement

লক্ষ্মীপুর ও মুন্সীগঞ্জ পাক হানাদারমুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিন মুন্সীগঞ্জের আপামর মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই দিনেই জেলা সদরের রতনপুর গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন অনু। অকুতোভয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার চোখের সামনে এখনো সেই দিনের স্মৃতি ভেসে ওঠে। মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক বাহিনীর সেই দিনের সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনু। ১৯৭১ সালের এইদিনে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াইয়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখল থেকে লক্ষ্মীপুর শত্রুমুক্ত হয়। দিনটি একদিকে ছিল বিজয় আনন্দের, অপরদিকে স্বজন হারানোর বেদনার। নয় মাস মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে রামগতি, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক খণ্ডযুদ্ধ হয়। এর মধ্যে রামগঞ্জ-মীরগঞ্জ সড়কে ১৭ বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন অনু একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে বলেন, দেশের অবস্থা খুব খারাপ। পাকিস্তানিরা পাখির মতো এ দেশের মানুষ মারছে। আর বসে থাকার অবসর নেই। আমার দিন-খন মনে নেই। আগরতলা দিয়ে চলে গেলাম ভারতে। ট্রেনিং নিয়ে আসার পর আমাকে মুন্সীগঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমি আর এসপি আনোয়ার মিলে সুখবাসপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য একটা সেন্টার খুলি। সেখানে একটা জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেই। কতদিন যুদ্ধ চলবে জানিনা। ভারত যাওয়া-আশা অনেক কঠিন। অনেক সময় লাগে। আর পথেও অনেক বিপদ। তাই আমরা ট্রেনিং সেন্টার খুলি। সেখানে ট্রেনিং দিয়ে যোদ্ধা তৈরি করি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী। তিনি পরে ট্রেনিং দিতে আমাদের সঙ্গে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজনকে দিয়ে যান; তার নাম মনে নেই। তখন ছিল অক্টোবর মাস। ধলাগাঁও বাজারে আমাদের সঙ্গে পাক বাহিনীর যুদ্ধ হয় দুই ঘণ্টা। যুদ্ধে তিন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পরে ৪ নভেম্বর আমরা টঙ্গীবাড়ী থানা দখল করি। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ সদর থানা অপারেশনের পরিকল্পনা করি। সেদিন ছিল সবেবরাত। ৭-৮টি দল গঠন করি। প্রত্যেক গ্রুপে ৮ জন করে ছিল। আমি ৮ জন নিয়ে থানার পাশে ছিলাম। আমাদের মধ্যে একজন সংকেত দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আসাদ নামের একজন ফাঁকা গুলি ছোরে। আমরা একজোট হয়ে আক্রমণ করি। সে যুদ্ধে পাকিস্তানিরা রাতেই পালিয়ে যায়। আমরা তখন উল্লাসে ফেটে পড়ি। থানার অস্ত্রগার লুট করি। পাকিস্তানিদের চারদিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলি।

advertisement

আনোয়ার হোসেন অনু আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করার খবর আসতে শুরু করে। এতে মুন্সীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা থেকেই জেলার বিভিন্ন এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংঘবদ্ধ হতে থাকেন। পরিশেষে ৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে মর্টারশেল নিক্ষেপ করলে এসপি কাজী আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রতনপুর এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন মুক্তিযোদ্ধারা। সেখানে ৫টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পাকবাহিনীও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা রতনপুর ব্রিজ ভেঙে দিলে গ্রামে ঢুকতে পারেনি পাকবাহিনী। এ ছাড়া রতনপুর, রামপাল, ধলাগাঁও এবং মিরকাদিম এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে থাকে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য অবস্থানের মুখে বেকায়দায় পড়ে যায় পাকবাহিনী। এ সময় মিত্রবাহিনীর বিমানবহর থেকে গুলিবর্ষণ করলে পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে। এভাবেই রতনপুরে সম্মুখ যুদ্ধে পাক হানারদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় আসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। সম্মুখ যুদ্ধে স্থানীয় ১৫ জন বাঙালি নিহত হয়। পরে ৬ জন পাকসেনার মরদেহ সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

এদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীপুর জেলায় ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক বাঙালি শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২৩ জন, রামগতিতে ২ জন, কমলনগর ১ জন, রায়পুরে ৭ জন ও রামগঞ্জে ২ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ ছাড়াও পাকিস্তানি বাহিনীর শতাধিক সৈন্য এবং পাঁচ শতাধিক রাজাকার নিহত হয়। এর মধ্যে বাগবাড়ী মাদাম ব্রিজের পাশে ৭০ পাকিস্তানি সেনা যুদ্ধে মারা যায়।

advertisement