বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সড়ক-মহাসড়কে বিশেষ তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর সব প্রবেশপথে বসানো হয়েছে তল্লাশি চৌকি। আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসে গতকাল শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত কড়া তল্লাশি চালানো হয়েছে। গণপরিবহনের পাশাপাশি মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত যানকেও কড়া তল্লাশির মধ্য দিয়ে ঢুকতে হয়েছে ঢাকায়; পড়তে হয়েছে পুলিশের জেরার মুখে। যদিও এদিন ঢাকা অভিমুখী দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল ছিল কম। রাজধানীতেও সকাল থেকে গণপরিহন কম চলাচল করতে দেখা গেছে। মানুষের মধ্যে দেখা গেছে আতঙ্ক ও উদ্বেগ। পুলিশের দাবি, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই এ তল্লাশি চালানো হচ্ছে। গতকাল দুপুরে গাবতলী এলাকায় দেখা যায়, তল্লাশি চালাতে আমিনবাজার সেতুর ওপর চারটি ব্যারিকেড বসানো হয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যান চলাচল। সেখানে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বগুড়া, রাজবাড়ী, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দূরপাল্লার প্রতিটি বাস থামিয়ে ভেতরে গিয়ে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলে, ওই যাত্রীর সঙ্গে থাকা ব্যাগ কিংবা বস্তা খুলে চালানো হচ্ছে তল্লাশি। বাসযাত্রীদের তল্লাশির সময় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও চালকের কাগজপত্র যাচাই করেছেন।
ফরিদপুর থেকে আসা একটি প্রাইভেট কারের চালক হাসিবুল হোসেন জানান, ঢাকায় আসার পথে তিনি তিনবার তল্লাশির মুখে পড়েছেন। সবশেষ গাবতলীতে তার গাড়িতে কড়া তল্লাশি চালানো হয়। তবে কেন ঢাকায় এসেছেন তা সব ঠিকঠাক বলতে পারায় তাকে ছাড়া হয়েছে। সকালে মানিকগঞ্জ গ্রামের বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে ফার্মগেটের বাসায় আসেন রাসেল আহমেদ। তাকেও দুই দফায় তল্লাশির মুখে পড়তে হয়েছে।
দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বলেন, ১০ ডিসেম্বর রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা বা নাশকতা না হয় সে জন্য তল্লাশি করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে তার ব্যাগ খুলে দেখা হচ্ছে। তবে ঢাকায় আসার সঠিক কারণ জানাতে পারলে ছেড়ে দিচ্ছেন তাকে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। গাবতলীতে দায়িত্ব পালন করা এসআই বায়েজীদ বলেন, নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে আমরা তল্লাশি করছি। তবে এখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আরও সতর্ক হয়ে দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে।
এদিকে অনেকটা আতঙ্ক নিয়েই কেউ কেউ গতকাল ঢাকা ছেড়েছেন। গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় একাডেমিক পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম। পরীক্ষা শেষে গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে তিনি গুলিস্তান থেকে গোপালগঞ্জের বাস ধরেন। ডা. রফিক বলেন, পরীক্ষা দিয়ে ইচ্ছা ছিল ঢাকায় একদিন থাকার। কিন্তু শনিবার গণপরিবহনের সংকট তৈরি হবে। এ ছাড়া ঢাকার অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। তাই ঝুঁকি না নিয়ে ঢাকা ছাড়ছি।
জানা গেছে, মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার অল্প কিছু বাস এদিন ছেড়ে গেছে। তবে যাত্রী ছিল কম। চালকরা জানান, পথে পথে তল্লাশি করা হচ্ছে। যাত্রী বা চালক কেউ তল্লাশি থেকে বাদ যাচ্ছে না। আবার মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, গুলিস্তান, আরামবাগ, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, ফার্মগেটে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে- যানবাহন চলাচল তেমন নেই। যেসব বাস চলছে, যাত্রী পাচ্ছে না তেমন।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কেও পুলিশ র্যাবকে টহল দিতে দেখা গেছে। মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশের সতর্ক পাহারা। পাশাপাশি মতিঝিল, শাপলা চত্বর, ফকিরাপুল, সচিবালয় এবং জিরো পয়েন্টসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় র্যাবকে চেকপোস্ট বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি করতে দেখা গেছে।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গজারিয়ার বিভিন্ন পয়েন্টেও পুলিশ চেকপোস্ট বসানো হয়। সেখানে ঢাকামুখী দূরপাল্লার বাস, ব্যক্তিগত গাড়িসহ অধিকাংশ যানবাহনে তল্লাশি চালায় পুলিশ। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত গজারিয়ার বাউশিয়া পাখির মোড়, দরি বাউশিয়া, ভবেরচর বাসস্ট্যান্ড, আনারপুরা, ভাটেরচর ও জামালদী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চেকপোস্টে চলে কড়া তল্লাশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রুটে চলাচলকারী এস আলম পরিবহনের বাসচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, কুমিল্লা থেকে ভবেরচর পর্যন্ত ১০ জায়গায় পুলিশ বাসের কাগজপত্র দেখেছে। তবে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।
মুন্সীগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান জানান, ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে জেলাজুড়ে সতর্ক অবস্থানে আছে পুলিশ। চেকপোস্টগুলোয় রুটিন তল্লাশি চলছে, যেন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকিয়ে দেওয়া যায়।
ডেমরা প্রতিনিধি জানান, ঢাকা শহরের প্রবেশদ্বার সুলতানা কামাল সেতুর পশ্চিম পাড়ে গতকাল পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে সন্দেহভাজন যাত্রীদের ওপর কঠোর তল্লাশি চালানো হয়। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করায় থানা এলাকায়ও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ডেমরা থানার অপারেশন অফিসার (ইন্সপেক্টর) সুব্রত কুমার পোদ্দার বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী কড়া সতর্ক অবস্থায় রয়েছে পুলিশ। সন্দেহভাজন যাত্রীদের তল্লাশিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে যাত্রীদের হয়রানি করা হচ্ছে না।
কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল উপজেলা থেকে রাজধানীর তিন প্রবেশমুখ পোস্তগোলা সেতু, বাবুবাজার সেতু ও বছিলা সেতুর কেরানীগঞ্জ প্রান্তে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সড়কে পুলিশের টহল দেখা গেছে। এসব সড়কে চলাচলকারী যানবাহনেও চালানো হয়েছে তল্লাশি। এ ছাড়া উপজেলার ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সার্বক্ষণিক পুলিশ সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নেন। অপরদিকে ঢাকা জেলা নৌপুলিশের একটি টিম বুড়িগঙ্গা নদীতে টহল জোরদার করেছে। ঢাকা জেলা নৌপুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পঙ্কজ চন্দ্র রায় জানান, সামনে কয়েকটি জাতীয় দিবস ও নৌপথে চলাচলে নিরাপত্তার জন্য আমাদের এ টহল। সাধারণ মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে এবং যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
বিএনপি ভেবে ব্যবসায়ীকে মারধর : রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে গতকাল বিএনপি কর্মী ভেবে এক ব্যবসায়ীকে মারধর করেছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ওই ব্যবসায়ী হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা তার পথরোধ করে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মারধর করে।
নয়াপল্টনে মুসল্লিদের বাধার অভিযোগ : বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সংলগ্ন নয়াপল্টন মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে বের হতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুসল্লিরা অভিযোগ করেন, তাদের অনেককে জুমার নামাজে আসতে দেয়নি পুলিশ। যারা কষ্ট করে মসজিদে গেছেন, তাদের বের হতে দিচ্ছে না। এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, মুসল্লিদের ছদ্মবেশে জামায়াতে ইসলামী পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করার চেষ্টা করছে। জুমার নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা যে যার মতো বাসায় চলে গেছেন। পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছে। কিন্তু এখানে ৪০ থেকে ৫০ জন নারায়ে তাকবির স্লোগান দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছে।
পুলিশ দেখে বাসযাত্রীর দৌড় : সকাল ১০টার দিকে ঢাকা-ফেনী রুটে চলাচল করা স্টারলাইন পরিবহনের একটি বাস থামানো হয়। বাসের ভেতরে থাকা গাউস আহমেদ নামে এক যাত্রীকে তল্লাশির জন্য নিচে নামতে বলে পুলিশ। কিন্তু বাস থেকে নেমেই দৌড় দেন ওই যাত্রী। এর পর কয়েকজন পুলিশ ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলেন। গাউস জানান, পুলিশ দেখে তিনি ভয়ে দৌড় দিয়েছেন। যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মো. ইব্রাহিম জানান, গাউস আহমেদকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।