অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো রাজনৈতিক বিজ্ঞানও একটি গুরু্ত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমরা জানি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রচলন শুরু করেছিলেন তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় ৭৫-এর ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর রাজনৈতিক বিজ্ঞান চর্চা করা তো দূরের কথা, স্বাভাবিক রাজনীতির ধারা-উপধারার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। গণতন্ত্রবিহীন অন্ধকার রাজনৈতিক জগতে শিক্ষার পরিবর্তে দূর্বৃত্তায়ন, স্বৈরতন্ত্র ও ইতিহাস বিকৃ্তির অপসংস্কৃতি চালু হয়।
রাজনীতিতে বিজ্ঞান যে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তার উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে সরকার ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তথ্য ও প্রযুক্তির কল্যাণে প্রধানমন্ত্রীর গ্রামকে শহর বানানোর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দোরগোড়ায়। মূলত শেখ হাসিনা সরকারের যে কয়টি মন্ত্রণালয় জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে তার অন্যতম বিজ্ঞানভিত্তিক মন্ত্রণালয় ‘আইসিটি।’ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে শহর থেকে গ্রামে তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার সমান তালে বিরাজমান। একজন উদ্যোক্তা ও তার বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাশক্তি দেশ-জাতিকে স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করিয়েছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মানুষ যাকে ডিজিটাল বাংলার প্রবর্তক হিসেবে জানে।
দুঃখজনক হলেও এটা সত্য বাংলাদেশে যে কয়টি রাজনৈতিক দল পরিচিতি লাভ করেছে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চার অভাব লক্ষ্যণীয়। আওয়ামী লীগ বিজ্ঞানভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা শুরু করলেও সাংগঠনিক পর্যায়ে বিজ্ঞানভিত্তিক নেতার সংখ্যা একেবারেই কম। আমরা জানি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সব চাইতে প্রবীণ, ঐতিহাসিক এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। যে দল নেতৃত্ব দিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে, যার বদৌলতে আমরা পেয়েছি স্বাধীন ভুখণ্ড, লাল-সবুজ পতাকা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছে জাতির পিতা। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি সম্মেলনে জাতির সামনে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার অবিরত চেষ্টা ছিল।
সময়ের প্রয়োজনে বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৬৬ সালে এক ঐতিহাসিক কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ওই বছরেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বলা যায় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ এবং ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক এক পরিবর্তন ঘটে। ৬৬-এর ওই সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমেদ। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোগী।
বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের সমন্বিত রাজনীতিতে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনবান্ধব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল, যা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সে সময়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মূল নেতৃত্বের প্রায় শতভাগ নেতা ছিল জনবান্ধব। দেশ ও দলের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু সারা বাংলা চষে বেড়িয়েছেন। কত মানুষের কাছে গেছেন, কত জনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন তা গবেষণার বিষয়। সারা বাংলা অবিরাম বিচরণ করে বঙ্গবন্ধু এমন কিছু নেতার সন্ধান পেয়েছিলেন যারা আজও স্মরণীয়।
নতুন প্রজম্মের সুবিধার্থে তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেক করা হলো। ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রাজশাহীতে কামরুজ্জামান হেনা, অবিভক্ত পাবনার এম ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, চট্টগ্রামের জহুর উদ্দিন আহমেদ, যশোরে শেখ আব্দুল আজিজ, খুলনার এম এ আজিজ, টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান, চাঁদপুরের মশিউর মিজানুর রহমান চৌধুরী, দিনাজপুরের অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রমুখ। তারা সাংগঠনিক দক্ষতা ও সততার কারণে আওয়ামী লীগের জন্য সম্পদে পরিণত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান যে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, আওয়ামী লীগ যে একটি জনপ্রিয় দল হয়ে উঠল, তার জন্য নেপথ্যে এক ঝাঁক নেতার নিরলস চেষ্টার কথাও মনে রাখতে হবে।
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পেলেন না। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বিপদগামী সেনাবাহিনীর একাংশ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র এবং ভারত বিরোধী জোটের বিপক্ষে সম্মিলিত আঘাত মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জন্য এক নতুন বাস্তবতা জন্ম নেয়। বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু আওয়ামী লীগ আছে যেন পরাধীন কোনো এক দেশে। এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকে মাথা তুলতে না দেওয়ার জন্য অনেক অপচেষ্টা হয়েছে। খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার চূড়ায় উঠেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন তা মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগকে চলার পথ তৈরি করতে হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় ১৯৮১ সালে ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকেই দলের সভাপতি নির্বাচিত করে দল নেয় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সে সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা, শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, শিশুকন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সবাই দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। সম্মেলনের এক সপ্তাহ পর ২৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আইভি রহমান, আব্দুস সামাদ, আব্দুল মান্নান, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দিন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে দিল্লি পৌঁছান এবং শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একাধিক মিটিং করে দেশ ও দলের চিত্র তুলে ধরেন।
সব জেনে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে আসার প্রবল আগ্রহের কথা জানান। শুরু হয় নেত্রীকে দেশে আনার প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগের পক্ষে দেশ ও জাতিকে জানানো হয় আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৭ মে স্বদেশে আসবেন। তখন এখনকার মতো এত শক্তিশালী মিডিয়া ছিল না। তবুও ঝড়ের গতিতে নেত্রীর আসার খবর বাংলার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে শুরু হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের যড়যন্ত্র। সরকারের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায় আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মী।
১৭ মে ১৯৮১ সাল দিনটি ছিল সে সময়ের রাজনীতির মতোই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি আর দুর্যোগ সেদিন গতি রোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখো লাখো মানুষের মিছিলকে। প্রিয়নেত্রীকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা বিমানবন্দর জনসমুদ্রে পরিণত হয়। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, নেত্রী এলেন বিকেল ৪টায়। সে সময় অশ্রু আর বেদনার মহাকাব্য জন্ম নেয় বিমানবন্দরে। স্বাধীনতার অমর স্লোগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রধ্বনিতে ঘোষিত হয়েছিল ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে আমরা লক্ষ ভাই বেঁচে আছি, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’
নিজ দেশের মাটি ও জনতার প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান রেখে লক্ষ লক্ষ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।আ মার অবুঝ দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় আর সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহেনার কাছে সদূর দিল্লিতে রেখে এসেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার; বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার ও স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আওয়ামী লীগকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তিনি হয়ে উঠেন আওয়ামী লীগের ঐক্য আর সংহতির প্রতীক।
আগামী ২২তম সম্মেলনে তিনিই হবেন টানা দশমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি। নিজ প্রজ্ঞা আর মেধায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব দরবারে। তবে আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী রাজনীতিতে জনবিচ্ছিন্ন ও বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিবিদ সুকৌশলে ঢুকে দলের অতীত সুনাম বিনষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এ ছাড়া কিছু নেতার অগ্রহণযোগ্য কথায় দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। এখনই সময় তাদের দল থেকে বিদায় করার। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক ও জনবান্ধব নেতাদের অন্তর্ভুক্তি সময়ের দাবি।
ইব্রাহিম হোসেন মুন: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়