advertisement
advertisement
advertisement.

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থা ও বাস্তবতা

সালমা অ্যানি ও নন্দিতা হাসান
৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:০৩ পিএম | আপডেট: ৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:০৩ পিএম
advertisement..

ঢাকা নগরীতে ‘হিজড়া’ তথা তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের বসবাসের ধরণ অস্থায়ী বা ভাসমান বলা যায়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে, বর্তমানে ঢাকায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। সরকার এই জনগোষ্ঠীর সমান অধিকারের ঘোষণা দিলেও বাস্তব প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন।

এখনো দেশের সাধারণ নারী পুরুষের মতো তাদের সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তারা নানা সুবিধাবঞ্চিত এবং অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত। বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রেও তারা অবহেলার শিকার হয়ে আসছে। স্বাস্থ্যসেবা পেতেও তাদের বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণা প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনমানের এ বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে।

advertisement

এমনই একটি গবেষণা প্রকল্পের নাম কমিউনিটি লিড রেসপন্সিভ এবং ইফেক্টিভ আরবান হেলথ সিস্টেম (কোরাস)। কোরাস একটি গবেষণামূলক কনসোর্টিয়াম যেখানে আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য গবেষকেরা একত্রে কাজ করছেন। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন অব্যাহত থাকায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বজায় রাখতে লড়াই করতে হচ্ছে। শহরে দরিদ্র কমিউনিটির স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা প্রায়শই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কোরাস প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো, এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গে শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা তৈরিতে সহায়তা করা। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে অসংক্রামক ব্যাধি বিশেষ করে হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যথাযথভাবে জোরদার করা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর্ক ফাউন্ডেশন। এই প্রকল্পের গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে নারী ও পুরুষ রোগীদের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সমাজের প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো তেমন কোনো সম্মান পান না। এখনো তাদের মেলেনি যথাযথ স্বীকৃতি। তাদের আচার-আচরণ, চালচলনে ভিন্নতার কারণে তাদের প্রতি সমাজের তীব্র নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ফলে এ মানুষগুলো সমাজে চরমভাবে নিগৃহের শিকার হচ্ছেন। সমাজের কাছে ন্যায্য পাওনার পরিবর্তে তারা পাচ্ছে ঘৃণা, অবজ্ঞা ও অবহেলা; হচ্ছেন নানা ধরনের বিদ্রুপ ও হয়রানির শিকার। ফলে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তারা কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই বেঁচে থাকার তাগিদে তারা দলবেঁধে সমাজের বিভিন্ন স্তরে টাকা সংগ্রহের কাজ করে থাকে। এই কাজ করতে গিয়ে তাদের অনেক সময়ই বেশিরভাগ মানুষ চাঁদাবাজ বলে সম্বোধন করেন।

রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে একজোড়া চটি পরে, নিজেকে বিভিন্ন সাজে সজ্জিত করে, শহরের ব্যস্ত রাস্তা-ঘাটে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় পাবলিক কিংবা প্রাইভেট পরিবহণে তাদের টাকা সংগ্রহ করতে দেখা যায়। রোদ্রতপ্ত দিনে দীর্ঘসময় নানা মানুষের কটূক্তি শুনে এভাবে টাকা সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা। অনেক সময় রাস্তার পাশের কোনো ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে নিজেকে কিছুটা সামলে নেন। এরপর আবার নেমে পড়েন জীবিকার সন্ধানে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ফার্মেসি বা বিভিন্ন ওষুধের দোকানও তাদের জন্য আরেক বঞ্ছনার জায়গা।

কোরাস প্রকল্পের সাক্ষাৎকারে তৃতীয় লিঙ্গের এমনকিছু মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে গিয়ে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

একদিন গরমে টাকা সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে নানা মানুষের কটূক্তি শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েন তৃতীয় লিঙ্গের সুমাইয়া (ছদ্মনাম)। তখন রাস্তার পাশে একটি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে গিয়ে ‘তোদেরও রোগ হয়!’, এই বলে নানান বিদ্রুপ শুনে তাকে ওষুধ কিনতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এ সময় অন্য কাস্টমারদের জন্য দোকানদার তাকে দ্রুত দোকান ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়।

অপরদিকে হাসপাতালগুলোতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিগৃহীত হওয়ার মাত্রা আরেকটু বেশি দেখা গেছে। ‘হিজড়া’ হওয়ার কারণে ১৭ বছর বয়সী ঐশী (ছদ্মনাম) স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতালে গিয়ে বঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে তিনি তার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। অসুস্থতা নিয়ে লম্বা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর হাসপাতালের একজন স্টাফ তাকে ‘সবার শেষে আস’ বলে অপেক্ষা করতে বলে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে এমন নানা ধরনের বঞ্ছনার শিকার হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষ। দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্যসহ নানা সমস্যার কথাগুলো অকপটে বলেছেন তারা।

রাজধানীতে বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার তত্ত্বাবধানে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করেছে। যদিও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো সব জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার উন্মুক্ত করেছে, তবুও এই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ গোষ্ঠী তাদের প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবার জন্য অনেক ক্ষেত্রে এলাকার ছোট ফার্মেসিতে গিয়ে সেবা নিচ্ছে।

করোনার চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারিয়া (ছদ্মনাম) নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বঞ্ছনার শিকার হয়ে চিকিৎসা না নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি তার অসুস্থ বোনকে নিয়ে ঢাকার এক প্রাইভেট হাসপাতালেও গিয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গ হওয়ার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আদেশক্রমে তাকে হাসপাতালের করিডোর থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি না হয়। সাধারণ রোগীদের মাঝে যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে না পরে সেজন্য নাকি তাদের সেখানে থাকা উচিত নয়।

তবে ফটকের ঝামেলা পেরিয়ে যদি কখনো তারা হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করেও থাকে, তাহলে স্বাস্থ্য সেবিকাসহ অন্য স্টাফদের ব্যবহার অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। ‘কেন এসেছ’ অথবা ‘সবার শেষে আস’ বলে অপেক্ষা করতে বলা হয়। 

১৫ বছর পরও সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে মৌলিক অধিকারটুকু চেয়ে পাননি সামিয়া (ছদ্মনাম)। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটু কাজের জন্য কোথায় না গেছি! কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। বিনিময়ে শুধু ঠাট্টা আর বিদ্রুপ করে। চিকিৎসার জন্য কোথাও গেলে কেউ চিকিৎসা দেয় না। জাতীয় পরিচয়পত্রও পাইনি। কাজ পেলেই তো আমাদের জীবন চালানো অনেকটা সহজ হয়ে যায়। টাকা যেদিকে, আইন চলে সেদিকে। আইনের আশ্রয় থেকেও আমরা বঞ্চিত। আমরা মানুষ হিসেবে অন্যদের মতো বাঁচতে চাই।’

সমাজ ও পরিবার থেকে বঞ্ছনা নিয়েই বেড়ে উঠেছেন তারা। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, সুন্দর এই পৃথিবীতে তাদের আসাটাই কি অপরাধ? তাদের নেই কোনো পরিবার, স্বামী, সংসার, সন্তান। এমনকি মানুষ হিসেবে সমাজে সম্মান বা কোনো পরিচয়ও নেই। এভাবেই নিজের আক্ষেপগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় গলা ভারি হয়ে ওঠে ৭০ বছর বয়সী গুরু মার।

যেহেতু শহরের বড় হাসপাতালে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রবেশের একটা প্রতিবন্ধকতা আছে, তাই তারা বাসার পাশে ছোট ফার্মেসিতে যেতেই বেশি স্বাছন্দ্যবোধ করেন। এসব মানুষগুলো হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলেও কোরাস প্রকল্পের গবেষণায় উঠে এসেছে।

সাধারণত প্রান্তিক নারী পুরুষের অধিকাংশই অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবনতা বেড়েছে। কিন্তু তার মধ্যে প্রান্তিক তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মধ্যে অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি বলে কোরাস প্রোজেক্টের গবেষণায় উঠে এসেছে। এর পিছনে নিম্ন আয়, অপরিচ্ছন্ন বাসস্থান (বস্তি), খাবারের নিম্নমান, তামাক ও মাদক সেবন, হতাশাসহ তাদের নিম্ন মানের জীবনব্যবস্থা দায়ী।

২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে হিজড়া গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়। সরকার এই ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সাম্প্রতি যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়েছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নে ইতোমধ্যে অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। তাদের শিক্ষা, চাকরি ও সরকারি হাসপাতালগুলোতে অন্য সবার মত চিকিৎসারব্যবস্থাও করা হয়েছে।

কিন্তু পরিস্থিতি এখনো বদলায়নি। এমনকি তাদের সমান অধিকার দেওয়ার মতো শক্ত কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। এখনো তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণ অপ্রীতিকর ও অস্বস্তিকর। তবে সরকারের যেহেতু তাদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিকতা রয়েছে, ফলে দ্রুতই তাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে প্রত্যাশা করতে পারি। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো তাদের জীবনমান উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে স্বাস্থ্যকর্মীসহ সমাজের সকলের আচরণগত এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনলে বাকি সবার মতো দেশের উন্নয়নে তারাও ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

সালমা অ্যানি ও নন্দিতা হাসান: রিসার্চ অ্যাসিস্টট্যান্ট, আর্ক ফাউন্ডেশন
কৃতজ্ঞতা: দীপা বড়ুয়া, তাহমিদ হাসান, ইব্রাহীম খলিল, আর্ক ফাউন্ডেশন