মাত্র এক যুগ আগের কথা। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরাত’ নূরুল ইসলামের। আর এখন? রাজধানীর আদাবর থানার ঢাকা উদ্যানের বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে ডি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৬৬ নম্বর বাড়িটির মালিক তিনি। তিনতলা এই বাড়ির দেড় শ গজ দক্ষিণে গড়ে তুলেছেন মার্কেট। আলকা বাজার নামের এ মার্কেটের উদ্বোধন হয়েছে গত ১ জানুয়ারি। মার্কেটের ৫শ গজ দূরে আরও একটি দোতলা বাড়ি কিনেছেন কয়েক বছর আগে। চন্দ্রিমা মডেল টাউনের বি-ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর হোল্ডিংয়ের এ বাড়ির উত্তর দিকের রাস্তা পার হলেই নবীনগর হাউজিং। এর ৮ নম্বর রোডের ৭০/৮০ নম্বর বাড়ির মালিকও তিনি। আর পরিবারসহ বসবাস করেন মোহাম্মদপুরে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ডি-ব্লকের ৩ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে। অথচ চাকরি কিংবা দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই তার। এক সময় ৩৯শ টাকা বেতনের এ কর্মচারী এখন শতকোটি টাকার মালিক। তার এ বিপুল বিত্তবৈভব এসেছে মরণনেশা ইয়াবা ‘ম্যাজিকে’।
নূরুল ইসলামের মোহাম্মদপুরের বাড়িটির ভাড়াটিয়া ও স্থানীয়রা বলছেন, এক যুগ আগেও নূরুল ইসলামকে কেউ চিনতেন না। হঠাৎ করেই তিনি একের পর এক বাড়ি ও প্লট কিনতে থাকেন। নিজেকে কাস্টমসের বড় কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া নূরুল ইসলাম এখন অন্তত ৩০ থেকে ৩২টি বাড়ি ও প্লটের মালিক। দৈনিক আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে শুধু মোহাম্মদপুরেই তার ৪টি বাড়ি ও একটি মার্কেটের মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীতে তো বটেই- সাভার ও কক্সবাজারেও তিনি কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নূরুল ইসলামের বাড়ি ভোলা সদর থানার ধনিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম কানাইনগরে। তার বাবার নাম আব্দুল মোতালেব। নূরুল ইসলাম কক্সবাজারের টেকনাফে কাজের সন্ধানে যান ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সালে টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্কস্টেশনে
কম্পিউটার অপারেটর পদে চুক্তিভিত্তিক চাকরি পান। তখন তার মাসিক বেতন ছিল ৩৯শ টাকা। সে সময় বন্দরে পণ্য খালাস ও পরিবহনের সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনার একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। বন্দরে নিজের লোক নিয়োগের পর ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দেন। এর পর আস্থাভাজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য আমদানির আড়ালে ইয়াবা পাচার শুরু করেন। পাশাপাশি নিয়োগবাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন নূরুল ইসলাম। কক্সবাজার এলাকায় নিজের প্রভাব বাড়াতে একটি বিয়েও করেন। প্রথমদিকে ইয়াবা কারবার থেকে কামানো অর্থ ব্যাংকে রাখলেও পরবর্তী সময়ে ঝুঁকি এড়াতে নগদ টাকায় জমি ও বাড়ি কেনা শুরু করেন। নিজের নামে বাড়ি ও জমি কেনার পাশাপাশি স্ত্রী ও স্বজনদের নামেও সম্পদ গড়ে তোলেন।
মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের তিনতলা বাড়ির নিচের চায়ের দোকানে বসে প্রতিবেদকের কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। তারা বলেন, প্রায় ৮ বছর আগে তিনতলা বাড়িটি কেনেন নূরুল ইসলাম। শুধু ঢাকা উদ্যানেই তার কয়েকটি বাড়ি ও প্লট রয়েছে। তবে তিনি এই বাড়িতে থাকেন না। ভাড়াটিয়ারা জানান, তিনতলা বাড়িতে ৪৩টি রুম রয়েছে। এগুলো ছোট ফ্যামিলির জন্য এক রুমের বাসা। এ ছাড়া ২টি বড় ফ্ল্যাট রয়েছে। নিচতলায় ২টি দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
একই সড়কে আলকা বাজার নামের একটি মার্কেট করেছেন নূরুল ইসলাম। ১ জানুয়ারি উদ্বোধন হওয়া এ মার্কেটের সামনে দোকান বরাদ্দের একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। মার্কেটের এক দোকানদার বলেন, এখানে একটি বাড়ি কিনেছিলেন নূরুল ইসলাম। পাশেই ছিল তার কিছু দোকানপাট। এখন বাড়ি ভেঙে পুরোটা মার্কেট করা হয়েছে।
হঠাৎ বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে ওঠার কিছু তথ্য পাওয়া যায় নূরুল ইসলামের আয়কর বিবরণীতে। আমাদের সময়ের হাতে আসা আয়কর বিবরণীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ৩০ জুন তিনি প্রথম আয়কর বিবরণী দাখিল করেন। তাতে স্থাবর-অস্থাবর মোট সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ ছিল সাড়ে ৮ লাখ টাকা। কোনো চাকরি বা প্রদর্শনযোগ্য ব্যবসা না করলেও ১১ বছরের মাথায় ২০২০ সালের আয়কর বিবরণী অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর তার স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৩ কোটি টাকা। তিনটি কোম্পানির মাধ্যমে এক দশকে তিনি এসব সম্পদ অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে আয়কর বিবরণীতে। অনুসন্ধান বলছে, বাস্তবে নামে-বেনামে তার সম্পদের পরিমাণ শতকোটি টাকা।
ঢাকা কর অঞ্চল ১২-এর নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঢাকার মোহাম্মদপুরের চারটি বাড়ি কেনার বিনিয়োগ ও বাড়ি থেকে প্রাপ্ত ভাড়ার আয় নূরুল ইসলাম গোপন করেছেন। তবে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিদ্যুৎবিলের কপি থেকে তার কেনা বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মেসার্স আল নাহিন এন্টারপ্রাইজ, মিফতাহুল এন্টারপ্রাইজ ও আপকা এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে নূরুল ইসলামের। তবে ৩টি কোম্পানিই ভুয়া, স্রেফ কাগুজে প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে এসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব খোলার সময় কেওয়াইসি ফরমের সঙ্গে এসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সও সংযুক্ত করা হয়। কার্যত অবৈধ মাদক কারবারের মাধ্যমে কামানো বিপুল পরিমাণ অর্থ সাদা বা বৈধ করার উদ্দেশ্যে নিজের ও স্ত্রীর নামে তিনি সেল কোম্পানি গঠন করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি বিক্রিই নূরুল ইসলামের বিপুল অর্থবিত্তের মূল উৎস। ইয়াবা কারবারের এ কালো টাকা সাদা করার কৌশল হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে।
ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১২ সালের নূরুল ইসলাম ইসলামী ব্যাংকের মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট শাখায় ২৫ লাখ টাকা জমা করেন। চার মাস টাকা তুলে ব্যাংক হিসাবটি বন্ধ করে দেন। ২০১৩ সালে একই ব্যাংকে অপর একটি হিসাব খুলে ৪০ লাখ টাকা জমা করে সেই টাকা উত্তোলনের পর অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করেন। কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই তিনি বেশিদিন টাকা রাখতেন না। টাকা জমা করার পর তা উত্তোলন করে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়া নূরুল ইসলামের ইয়াবার টাকা লেনদেনের একটি কৌশল। অনুসন্ধান তা-ই বলছে। সর্বশেষ একই ব্যাংকের অন্য একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা তুলে হিসাবটি বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের শ্যামলী শাখায় তার নিজ নামে খোলা অ্যাকাউন্টে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকা জমা ও উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে। একই শাখায় মেসার্স আল নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজের নামে প্রায় ৮ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন তিনি। তার স্ত্রী রাজিয়া ইসলামের ৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। স্ত্রী রাজিয়ার নামে নূরুল ইসলামের কেনা বিপুল জমি ও প্লটের সন্ধান পেয়েছে আমাদের সময়। যার মধ্যে রয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রামচন্দ্রপুর মৌজায় ৩ কাঠা জমি, যার দলিল মূল্য ১২ লাখ টাকা। একই এলাকায় ৭.৪৭ শতাংশ জমি, দলিল মূল্য ৬২ লাখ টাকা। আমিনবাজারের বড়দেশী মৌজায় ৫৩ শতাংশ জমি, দলিল মূল্য ৬৩ লাখ টাকা। কক্সবাজারের টেকনাফে তার স্ত্রীর নামে কেনা হয়েছে ২৪ শতাংশ জমি। জানা গেছে, জমির দলিলে কম মূল্য দেখানো হয়েছে। বাস্তবে মূল্য দলিল মূল্যের কয়েকগুণ।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়গুলো তদন্ত করে থাকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ বিষয়ে সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, নূরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী রাজিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধ মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের কারবারের অভিযোগ তারা পেয়েছেন। নূরুল ইসলাম ইয়াবাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। মাদক বিক্রি থেকে প্রাপ্ত টাকা তারা সেল কোম্পানির ব্যানারে আয়করের মাধ্যমে বৈধ করছেন এবং পরবর্তী সময়ে পাচার করে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অপরাধের প্রমাণ পেলে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে।
এসব বিস্তর অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য রাজধানীতে তার মালিকানাধীন তিনটি বাড়িতে গিয়েও নূরুল ইসলামের দেখা পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত রবি মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। তার স্ত্রী রাজিয়া ইসলাম আমাদের সময়কে জানান, নূরুল ইসলাম নিজেই বৈধ ব্যবসা করে সম্পদ করেছেন। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাদের ফাঁসানো হচ্ছে বলে উল্টো অভিযোগ করেন রাজিয়া। বলেন, আমরা যে পরিমাণ সম্পদের মালিক বলে বলা হচ্ছে, সেই পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই।
রাজিয়া ইসলাম বলেন, আমাদের যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তা সরকারিভাবে দেখানো হয়েছে। সবই দৃশ্যমান সম্পদ। মোহাম্মদপুরে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়িতে আমরা থাকি। অন্যান্য বাড়ি ভাড়া দেওয়া আছে।
কয়টি বাড়ি ও কী পরিমাণ সম্পদ আছে?- এ প্রশ্নে রাজিয়া বলেন, ‘সেটা আমি বলব না। নিজের সম্পদের কথা কেউ বলে না।’ এর পরই তিনি যোগ করেন, ‘মোহাম্মদপুরের বাড়ি ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্পদ নেই। আমরা বিপদগ্রস্ত। আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে।’
হঠাৎ করে শতকোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার বিষয়ে রাজিয়া বলেন, ‘মানুষের তো সব সময় টাকা থাকে না। ব্যবসাবাণিজ্য করে সবাই সম্পদ গড়ে। আমরাও তাই করেছি। আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় অর্থ আয় করেছি।