advertisement
advertisement
advertisement.

নিজের বইয়ের নিজে প্রচার- বিষয়টা কেমন

মৌলি আজাদ
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:০৬ পিএম
advertisement..

ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। বছরের আর এগারোটি মাসের চেয়ে এ মাস সম্পূর্ণ আলাদা। এ মাস বাঙালির আবেগকে ধারণ করে যেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বইমেলা। আমাদের দেশে প্রধান যে উৎসবগুলো রয়েছে তা থেকে বইমেলা যেন এতটুকুও পিছিয়ে নেই। বর্তমানে বইমেলা বাকি উৎসবগুলোর মতোই রঙিন ও বর্ণিল। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে লেখক-পাঠকের মন বইমেলায় যাওয়ার জন্য উসখুস করতে থাকে।

করোনা মহামারীর কারণে বেশ কয়েক বছরের বিরতির পর এবার বইমেলা শুরু হয়েছে পুরনো তারিখে অর্থাৎ পহেলা ফেব্রুয়ারিতে। বইমেলার কথা মনে হলেই চোখে ভাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ।

advertisement

যারা তরুণ লেখক, তাদের বইমেলার সময় মনের ভেতর কী অবস্থা থাকে, তা সেই তরুণ লেখক ছাড়া আর কে বা বোঝেন? নিজের লেখা সদ্য বের হওয়া নতুন বই দেখে তরুণ লেখকের সারা শরীর যেন কাঁপতে থাকে। নিশ্চয়ই বইটি তার বুকে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। স্টলের সামনে তরুণ লেখকের বইটি যখন পাঠক নেড়েচেড়ে দেখে তখন তরুণ লেখকের মন দুরুদুরু কাঁপে বৈকি। আর কেউ যদি অটোগ্রাফের জন্য তার দিকে বইটি বাড়িয়ে দেয় তখন তরুণ লেখকের মনের অনুভূতি হয় শূন্যে উড়ে যাওয়ার মতো যেন। উফ্ এত সুখ। পালাই পালাই অবস্থা যেন।

তরুণ লেখকদেরই প্রকাশিত বই নিয়ে বুকের ভেতর যে তোলপাড় হয়, তা কিন্তু নয়। যারা অনেক দিন ধরে লিখছেন তাদেরও বই নিয়ে ভালো লাগা ও চিন্তা দুটোই কাজ করে। এ বছর বইমেলার প্রথম দিনেই আগামী প্রকাশনীতে এসেছে আমার গল্পের বই ‘ইগলের চোখ’। লেখক কখনো পাঠক কী চায় সে চিন্তা করে লেখেন না, কিন্তু বই প্রকাশের পর পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে কিনাÑ সে চিন্তা কমবেশি সব লেখকেরই থাকে।

আমাদের দেশে যত বই বের হয়, তত পাঠক নেই। পাঠকের চেয়ে কয়েকজন লেখকের ভক্ত তৈরি হয়। ইদানীং আমরা যারা লিখছি (নামকরা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকসহ) তারা নিজেদের বইয়ের প্রচার নিজেরাই করেন। এখন আর আগের মতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া বা বই নিয়ে লিফলেট প্রকাশের প্রয়োজন হয় না। এখন আমরা আমাদের প্রকাশিত বইয়ের প্রচার চালাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা ভিডিওতে। আমাদের প্রচারকে পুনঃপুন শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় আমাদের ভক্ত-অনুরাগীরা। ভক্তরা ফেসবুকে বইয়ের পোস্টে যতখানি লাইক/কমেন্টস/শুভকামনা জানায়, ততটা কি বই কেনেন? আজকাল নিজের ঢোল নিজে বাজানো যেন প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। চক্ষুলজ্জা বিষয়টি বেশ অচল সবখানে। তবে লেখকের দোষ কী? যুগটাই যে এখন এমন !

এটা ঠিক যে, লেখকের উপস্থিতিতে পাঠকরা বই কিনতে চান। হয়তো অটোগ্রাফের আশায়। সব লেখকের নির্দিষ্ট কয়েকজন পাঠক তো থাকেনই, সেই সঙ্গে বইমেলায় তৈরি হয় নতুন নতুন পাঠক। পাঠক পেলে লেখকের যেমন ভালো লাগে, পাঠকের কী লেখকের সঙ্গ কম ভালো লাগে? মোটেও নয়। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পাঠক বই নেওয়ার সময় কত কথা যে লেখকের কাছ থেকে জানতে চানÑ তা নিয়ে হয়তো আরেকটি প্রতিবেদন লেখা যেতে পারে। লেখককে কাছ থেকে দেখাই অনেক পাঠকের আনন্দ। যার লেখা বই কিনে পড়ছি তাকে চোখের সামনে দেখাÑ ব্যাপারটাই আলাদা। সিরিয়াস বই যিনি লেখেন তিনি কি বাস্তবেও সিরিয়াস? হাসির বই যিনি লেখেন তিনি কি গম্ভীর হতে পারেন না? আগামী প্রকাশনীর স্টলে বসলেÑ পাঠকের অনেক আবদার শুনিÑ যেমন তারা কিছু বিষয় নির্বাচন করে দেন লেখার জন্য। অনেক সময় পুরনো বই নিয়ে যেমন কথা বলতে চান, তেমনি নতুন আর কী লেখা মাথায় ঘুরছে তাও জানতে চান। জানতে চান লেখার প্রস্তুতি সম্পর্কে। সেই সঙ্গে একটা সেলফির অনুরোধ।

প্রতিবছর আমাদের বইমেলার পরিধি বাড়ছে যা আনন্দের। কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া নিচ্ছেন না। কারণটা খুব পরিষ্কার। লেখক-পাঠক সবাই বইমেলার প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন।

যারা জনপ্রিয় বা বিখ্যাত লেখক তারা তো বইমেলার মাসটি বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছেড়ে অন্য কোথাও থাকা বোধকরি চিন্তাও করতে পারেন না। বইমেলার প্রতিটি স্টলে থাকে নতুন বইয়ের গন্ধ। লেখকের চারপাশে থাকেন অটোগ্রাফ শিকারিরা। কিছু কিছু স্টলের সামনে থাকে পাঠকের সারিবদ্ধ লাইন। বুঝতে বাকি থাকে না যে, স্টলে বসে আছেন জনপ্রিয় কোনো লেখক। জনপ্রিয় লেখকের নতুন বই কেনার পর একটা অটোগ্রাফ না নিলে চলে কি? অন্য লেখকের মধ্যে এতে কি ঈর্ষাবোধ হয়? হতে পারে। হোক ঈর্ষা। একে নির্দোষ ঈর্ষা বলা যেতেই পারে। হয়তো এই ঈর্ষা দেয় তাকে আরও ভালো লেখার তাগিদ।

ইদানীং বইমেলা শুরু হওয়ার আগেই দেখছি অনেক লেখকের বই প্রি-অর্ডারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে বিকিকিনি হয়তো বাড়তে পারে। কিন্তু বইমেলা থেকে পাঠকের বই কেনার ইচ্ছা যে আনন্দ থাকে তা প্রি-অর্ডারে কিনলে বোধকরি থাকে না। ঢাকা শহরের ভিড়বাট্টা এড়িয়ে চলার জন্য সবকিছুই তো আমরা ‘টেইকএওয়ে’ সিস্টেমে নিয়ে এসেছি। ‘বই’ হয়তো এর বাইরে থাকলেই ভালো। তবে বইয়ের বিক্রি ভালো না হলে প্রকাশকের যে ‘হাঁড়িমুখ’ থাকে তা অবশ্য লেখকের জন্য অস্বস্তিকরই বটে। থাক সে কথা।

বইমেলা চলাকালীন পড়ে পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইন্স ডে। বইমেলায় তরুণ-তরুণীদের বাঁধভাঙা ঢল থাকে এই দুদিনে। অন্যদিন বই নেড়েচেড়ে দেখলেও সেদিন প্রায় সবাই তার প্রিয় মানুষকে পছন্দের বইটিই কিনে দেয়। এতে ভালোবাসার সঙ্গে যুক্ত হয় চমৎকার একটি অভ্যাস। তা হলো বই কেনা ও উপহার দেওয়া। বইমেলায় যারা আসেন, তারা কি সবাই বই কেনেন? বোধকরি না। অসুবিধী কী? বইয়ের চারপাশে ঘুরলে ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই ‘বই না কেনা’ মানুষটিরও মনোজগতে পরিবর্তন আসে। হয়তো হঠাৎ করে তার চোখে পড়ে যায় এতদিন মনে মনে সে যে বইটি খুঁজছিল সেই বইটি। হয়তো নামকরা লেখকের কঠিন বাক্যের হাজার শব্দের বই সেটি নয়, বিদগ্ধ পণ্ডিতরা নানাসময়ে সে বইটিতে ছুড়িকাঁচিও চালিয়েছেন। কিন্তু তাতে কী? সে তো বই-ই কিনেছে, নিষিদ্ধ কিছু তো কেনেনি। বইটি হয়তো তাকে দেখাতে পারে ভিন্ন একটি জগৎ (আটপৌরে জীবনে সে হয়তো এ রকম স্বাদ আগে পায়নি)।

সর্বোপরি লেখক-পাঠকের জন্যই তো মাসব্যাপী এই বইমেলা। বিশ্বায়নের এ যুগে লেখকের নিজের বইয়ের নিজে প্রচার মোটেও মন্দ কিছু নয়। এক লেখকের আরেক লেখককে খোঁচা মারার চেয়ে এটা ঢের ভালো।

বইয়ের প্রচার চলুক অবিরাম, পাঠক জানুক নতুন নতুন বইয়ের নাম। দেশটা হোক সৃষ্টিশীল মানুষদের।

মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক