advertisement
advertisement
advertisement

পাবনাবাসীর ধারণা অবশেষে বাস্তব হলো

মো. ইব্রাহিম হোসেন মুন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৪৩ পিএম | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৪৩ পিএম
নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন
advertisement

কথায় আছে ইতিহাস কথা বলে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আবার সেই ইতিহাসের বদৌলতে কোনো জাতি, ধর্ম-বর্ণ বা ব্যক্তি সর্বোচ্চ আসনে স্থান পায় তেমনি একটি বিরল ঘটনা দেখা গেল বাংলাদেশের মাহামান্য রাষ্ট্রপ্রতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে। নেই আলাপ, নেই গুঞ্জন—কিন্তু নক্ষত্রের উদয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, পণ্ডিত, মহাপণ্ডিত, ঝানু ঝানু রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক‌, কূটনীতিক কেউ ধারণাই করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কত বড় নক্ষত্রের উদয় ঘটালেন বাংলার জমিনে।

বাহাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ পুনরায় গঠনে ছুটে যান পাবনায়। লক্ষ্য যমুনার করাল গ্রাস থেকে পাবনাবাসীকে মুক্ত করতে একটি বাঁধ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করতে। তিনি নিজ হাতে কোদাল নিয়ে কাটলেন মাটি। সেই মাটি মাথায় নিয়ে যমুনার করাল গ্রাস থেকে পাবনাবাসীকে বাঁচাতে শুরু করে দিলেন বাঁধের নির্মাণকাজ। পাবনাবাসীর সেই মহেন্দ্রক্ষণে স্থান ছিল নগরবারী ঘাট। যা মুজিব বাঁধ নামে পরিচিত।

advertisement

বাঁধ তো উদ্বোধন হলো, এবার পাবনাবাসী বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে আবেগ-আপ্লুত, কত কথা, কত কিছু এর ফাঁকে মঞ্চে বিনম্র কন্ঠে সেই সময়ের পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মর্মস্পর্শী ভাষণ বঙ্গবন্ধুর নজর কাড়ে। বক্তব্য শেষ হলে মঞ্চ থেকে নামার সময় বঙ্গবন্ধু তার হাত ধরে ফেললেন, আদর আর মমতায় বুকে জড়িয়ে নিলেন, কপালে চুমু দিয়ে বললেন, ‘তুই তো ভালো বলিস। তোরে আগে কোথাও দেখেছি?’ উত্তরে বলেন, ‘জ্বি, দেখেছেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কোথায় বল তো?’ তিনি বলেন, ‘৬৬ ছয় দফা অন্দোলনের বার্তা নিয়ে পাবনায় বগা চাচার বাসায় মিটিং করছিলেন, চাচা আমায় পরিচয় করে দিয়েছিলেন। সেদিন আপনি আমাকে মাঠে যেতে বলেছিলেন, আমি সেই চুপ্পু (রাষ্ট্রপতি)।’

নিজ চোখে দেখা স্থানীয় এক বাসিন্ধা তার অভিপ্রায় বলতে গিয়ে বললেন, ওমন দৃশে সেসময়ে উপস্থিত অনেকের চোখে আনন্দে অশ্রু ছল ছল করছিল।

advertisement

প্রোগ্রাম শেষে হেলিকপ্টারে ওঠার সময় বঙ্গবন্ধু মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ঢাকায় যাবি, রাজি থাকলে চল।? ছাত্রনেতা হতবাক, আনন্দে রাজি হলেন। জীবনে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টারে ভ্রমণ, তাও আবার রাষ্ট্রপ্রতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। উঠে পড়লেন হেলিকপ্টারে। চলে গেলেন ঢাকায়, হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল তেজগাঁও বিমানবন্দরে। অতঃপর বঙ্গবন্ধু ক্যাপ্টেন মনসুরকে নির্দেশ দিলেন, ওকে বাসায় নিয়ে খেতে দাও। তারপর খরচ দিয়ে পাবনায় পাঠিয়ে দাও। সেদিন এমন ঘটনায় পাবনাবাসী ধারণা করেছিল, চুপ্পুই একদিন দেশের কিছু একটা হবে।

বাহাত্তরে সেই ধারণা আজ বাস্তব। পাবনাবাসী এখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। আজ বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই, তুমি দেখে যাও তোমার হেলিকপ্টারে ভ্রমণকারী সেই সাহাবুদ্দিন আজ মহামান্য রাষ্ট্রপ্রতি।

মো. সাহাবুদ্দিন পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল তিনি ভারতে যান এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে পাবনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেন। ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পেলেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বিপথগামী সেনাবাহিনীর একাংশ কাক ডাকা ভোরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত এবং ভারতবিরোধী জোটের বিপক্ষে সম্মিলিত আঘাত মোকাবিলা করা সম্ভাব হয়নি।

বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগে ও তার অঙ্গসহযোগী সংগঠনের জন্য এক নতুন বাস্তবতার জম্ম নেয়। বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু আওয়ামী লীগ আছে যেন পরাধীন কোনো এক দেশে। এমন পেক্ষাপটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে মাথা তুলতে না দেওয়ার জন্য অনেক অপচেষ্টাই হয়েছে। খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার চূড়ায় ওঠেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, তা মোকাবিলা করেই যে সমস্ত গুটি কয়েক নেতারা অদম্য সাহস নিয়ে রাজপথে ছিলেন অবিচল, তাদের মধ্যে মো. সাহাবুদ্দিন একজন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার মো. সাহাবুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হলো। নিয়ে যাওয়া হলো কারাগারে। এরপরে নানাবিধ ধকল তার এবং তার পরিবারবর্গের ওপর। দমিয়ে যাননি মো. সাহাবুদ্দিন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি পথ ভুলে যাননি। লেখাপড়া শেষ করে মো. সাহাবুদ্দিন ১৯৮০ থেকে দুই বছর দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা করেন। পরে আইন পেশায় যোগ দেন। শুরুতে তিনি পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন। ১৯৮২ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে তিনি মুন্সেফ (সহকারী জজ) পদে যোগ দেন। সাহাবুদ্দিন ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। কর্মের ধারাবাহিকতায় তিনি যথাক্রমে যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ পদে দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালে অবসরে যান।

সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন ১৯৯৯ সালে মো. সাহাবুদ্দিন প্রধানবিচারপতির নেতৃত্বে ১০ সদস্যবিশিষ্ট দলের সদস্য হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক আইন সম্মেলন’-এ যোগদানের জন্য চীনের রাজধানী বেইজিংসহ চীনের বিভিন্ন প্রদেশ পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন সেমিনারে যোগদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড সফর করেন। জাতিসংঘের অর্থায়নে এই সফর অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সফরে সংসদ সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ বেসামরিক আমলারাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা তদন্তে পরবর্তী সময়ে গঠিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান (সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদমর্যাদায়) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার কারণ ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত তাদের দাখিল করা প্রতিবেদন সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিচারিক কাজের পাশাপাশি তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেস্ক অফিসার হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের ১৪ মার্চ তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০১৬ সালে অবসরে যান।

দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংক থেকে উত্থাপিত কথিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তার পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদন কানাডার আদালত সমর্থন করে। 

তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ২২তম জাতীয় পরিষদে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মো. ইব্রাহিম হোসেন মুন: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়