সম্প্রতি ট্রেনে রাজশাহী যাওয়ার পথে পাশের সিটে বসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই তরুণের ভাষ্য, বিভাগের পড়াশোনার বাইরে চাকরির বই পড়েন নিয়মিত।
রাজনৈতিক ‘যোগাযোগ’ ছাড়া চাকরি হবে না ভেবে তিনি একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ওঠবস করেন। তাদের মিছিল-মিটিংয়ে যান। তার মতে, ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ তাকে অনেক সময় সেই কর্মসূচিতে যেতে হয়। তা না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকতে পারবেন না। তবে হলে থাকতে হলে অবশ্যই ওই নেতাদের কথামতো চলেতে হবে। না হলে থাকতে পারবে না। ঢাকায় হলের বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার খরচ বেশি। তাই ‘নিজের স্বাধীনতা সংকুচিত করে চাকরিতে সুবিধা পাওয়ার আশায়’ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
ওই ছাত্রের কপাল ভালো, তাকে শুধু মিছিল-মিটিংয়ে গেলেই হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ কিংবা সরকারি কলেজের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, হল কিংবা ক্যাম্পাস যেন ‘টর্চার সেল’ হয়ে উঠেছে। পত্রিকার পাতায় কিংবা অনলাইন সংবাদমাধ্যমে এসব খবরে ভরা। আপনি কোনটা থেকে কোনটা উল্লেখ করবেন, তার শেষ নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পেটানো হচ্ছে। ধর্ষণ কীভাবে করতে হয়, র্যাগিংয়ে তা মঞ্চায়ন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব কাজে আগে ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দেখা যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নেত্রীরাও এগিয়ে এসেছেন। ছাত্রীদের পিটিয়ে দেখাতে পারছেন, তারাও পেছনে পড়ে নেই। সময়ের চাহিদা মতো তারাও নিজেদের তৈরি করছেন।
দেশের প্রধান সমস্যা
এক বছর আগে বিবিসি বাংলা একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছিল দেশের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের। সেটা ইউটিউবে ও তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি দেশের প্রধান সমস্যার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে নম্বর ওয়ান প্রবলেম।’
একইভাবে কোনো তরুণকে যদি প্রশ্ন করা হয়, দেশের এক নম্বর সমস্যা কী? তাহলে উত্তর কী আসবে? যিনি চাকরি পাচ্ছেন না, তিনি হয়তো চাকরির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার কথা বলবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেও ক্যাম্পাসে সুন্দর-স্বাধীন পরিবেশে থেকে পড়াশোনার কথা বলবেন। বিচারপ্রার্থীরা সুবিচারের কথা বলবেন। চাকরিজীবীরা কর্মক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা দূর করার কথা বলবেন। ছাত্ররাজনীতিতে জড়িতরা বলবেন যোগ্যদের ঠাঁই হচ্ছে না ইত্যাদি। তবে সবকিছুর পেছনে যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা জড়িত, সহজেই সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।
আমরা সবাই একটি সুন্দর রাষ্ট্র চাই, সুন্দর সমাজ চাই। সোহেল তাজের মতে, তখনই এটা সম্ভব হবে, যখন ‘দুর্নীতি’ ও ‘অবব্যস্থাপনা’ সমাজ থেকে চিরতরে সরানো যাবে। এই দুটি সমস্যাকে সরাতে হলে পদ্ধতিগত পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, এ জন্য সুশাসন প্রয়োজন। সুশাসন তখনই হবে, যখন সুবিচার ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকবে।
সমাধান কোন পথে
মেধাভিত্তিক সমাজের প্রত্যাশা করেন সোহেল তাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই একটা মেধাবী সমাজ। এখানে যোগ্যতাই হবে মাপকাঠি, রাজনৈতিক যোগাযোগ নয়।’ তার কথা মতো সত্যিই যদি যোগ্যতা দিয়ে সব কিছু পাওয়া যেত, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তরুণকে আজ চাকরির জন্য পড়াশোনার বাইরে রাজনৈতিক যোগাযোগের পেছনে ছুটতে হতো না। তিনি শুধু ছুটতেন লাইব্রেরি ও বিভাগে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাকে লাইব্রেরি ও বিভাগের বাইরে রাজনৈতিক মাঠে দৌড়াতে হচ্ছে। এতকিছু করার পর তার সুন্দর ভবিষ্যৎ আসবে কি না, সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।
বর্তমান সমাজে শুধু মেধার জোরে যে কিছু হচ্ছে না, তার প্রমাণ অনেক আছে। তাই দেশ-সমাজ ধীরে ধীরে মেধাশূন্য হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতেও মেধাশূন্যতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘মেধাবীদের রাজনীতিতে আসা দরকার, তা না হলে রাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে।’ (আমাদের সময় অনলাইন, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১)
‘যারা বেশি দুর্নীতিবাজ, তারাই বেশি নীতির কথা বলে’ উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘মেধাবী মানুষ রাজনীতিতে না এলে মেধাহীনরা এমপি-মন্ত্রী হবে।’ (আমাদের সময় অনলাইন, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)
ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা
চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে থাকা দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, নিশ্চিত করে কোনো বুদ্ধিজীবী বা রাজনীতিক হয়তো বলতে পারবেন না। বিবিসি বাংলার ওই সাক্ষাৎকারে সোহেল তাজকে প্রশ্ন করা হয়, আগামী এক দশক বা দুই দশক সামনের বাংলাদেশের কী ভবিষ্যৎ আপনি দেখতে পান?
সেই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরাসরি কোনো উত্তর দিতে পারেননি সোহেল তাজ। যদি-তবে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের ফিউচার (ভবিষ্যৎ) ভালো দেখব তখনই, যদি দুটি জিনিসের (দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা) অবসান ঘটবে। যদি এই দুটির অবসান ঘটে, তাহলে ২০-৩০ বছরের মধ্যে অবশ্যই সুন্দর ভবিষ্যৎ আসবে।’
দেশের মাধ্যমিকের পাঠ্যবই নিয়ে কিছু দিন যে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে গেল, তা সবারই জানা। আমাদের ন্যায়বিচার, সুশাসন, আইনের প্রয়োগ, যোগ্যতার মূল্যায়নের পেছনে সেই পাঠ্যবইয়ের যোগাযোগ আছে। শিক্ষার সম্পর্ক রয়েছে। শুধু শ্রেণিকক্ষের পাঠদান নয়, অভিজ্ঞতার সমষ্টিই হলো শিক্ষা। আমরা ব্যক্তিজীবনে নিষ্ঠাবান, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ না হলে পরের প্রজন্ম সেটা শিখতে পারবে না। ছোটরা বড়দের দেখে শেখে। বড়রা দুর্নীতিবাজ হয়ে মুখে যতই নীতিকথা বলুক না কেন, ছোটরা তা শুনবে না। সেই নীতিকথা তাদের শেখানো যাবে না।
চলমান সামাজিক অবস্থার উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের হতাশার জায়গা থেকেই যায়। যেমনটা সোহেল তাজ বলেছেন, ‘হতাশ তো হবই আমরা, যদি সুবিচার না দেখি, যদি দেখি ইনজাস্টিস, যদি দেখি একজনের জন্য সবকিছু হচ্ছে আর অন্যজন কিছুই পাচ্ছে না।’
জাকির হোসেন তমাল: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আমাদের সময়
[email protected]