advertisement
advertisement
advertisement

৩-০! শুধু রসকষহীন অঙ্ক নয়

অঘোর মন্ডল
১৬ মার্চ ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪৬ এএম
9.jpg
advertisement

পরিশ্রম, সংকল্প আর একমনা থাকলে ভেতরে একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। যা সাফল্যের ভিত গড়ে দেয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে জয় বাংলাদেশের কাছে অজানা, অচেনা ছিল। সেই ইংলিশদেরই হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ! এই জয় এ দেশের ক্রিকেটীয় গৌরবলগ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ল। এটাই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে কোনো ফরম্যাটে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়। শত শত প্রথমের মিছিলে এই জয়ের গায়েও ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটা লিখে দেওয়া যায়। তবে লিখলেও তা এখন আর বাড়তি আবেগ যোগ করে না দেশের নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে!

বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের তিন ম্যাচ সিরিজে তিন-শূন্যতে হারানো! ক্রিকেটবিশ্ব তাকে ‘হোয়াইটওয়াশ’ বা ‘বাংলাওয়াশ’ যা ইচ্ছে বলতেই পারে। এ দেশের মানুষের কাছে এই সিরিজ ছিল জয়ের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার সিরিজ। সাকিব-লিটন-শান্ত-তাসকিনরা প্রচণ্ড নাছোড়বান্দার মতো সেই জয় খুঁজে বের করেছেন।

advertisement

৩-০! কারও কাছে রসকষহীন একটা অঙ্ক মনে হতে পারে। কিন্তু যারা ক্রিকেট ভালোবাসেন তারা ওর মধ্যেও হৃদয়ের ডাক শুনতে পেয়েছেন। হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা হিসেবে এটাকে তারা দেখবেন না। এই জয়ে সাকিবের দলের ক্রিকেটারদের মানসিক পরিকাঠামোর ভেতরে যতটা নিখুঁত, শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকা সম্ভব সেই চেষ্টা দেখা গেছে। সিরিজের শেষ ম্যাচটা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতল বাংলাদেশ, সেটা দারুণ। না জিতলে মনে একটা খুঁতখুঁতানি থাকত! ভেতর থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে পড়ত ‘আহ! হোয়াইটওয়াশের সুযোগ হাতছাড়া হলো!’ সেই আক্ষেপ, হাহাকার তাদের করতে হলো না। বরং বেশি উচ্চকিত কণ্ঠে তারা বলতে পারছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকেও ‘বাংলাওয়াশ’ করা যায়!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটা অন্তর্বর্তী সময় শুরু হয়েছে। অভিজ্ঞ, পোড়খাওয়া বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার তাদের ক্যারিয়ারের অন্তিম স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। তাদের জায়গায় তরুণদের সুযোগ দিতে হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ সামর্থ্যরে জানান দিচ্ছেন। পারফরমার সাকিবের অধিনায়কত্বের মাঝেও আগ্রাসী মেজাজ আর জয়ের খিদে প্রবল হচ্ছে। অধিনায়ক হিসেবে দলটাকে আগলে রাখার চেষ্টাও দেখা গেছে। প্রতিপক্ষের বুলেটের সামনে অধিনায়কই প্রথম বুক পেতে দিতে প্রস্তুত। এই বার্তাটা তিনি দিতে পেরেছেন। মেহেদী-তাসকিন-শান্তর মতো তরুণরা তাই নিজেদের উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করছেন না। টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে বাংলাদেশ কি পারবে! এ রকম প্রশ্ন সত্যিই অনেকের মনে উঁকি দিয়েছিল। সেই অবিশ্বাসী মানুষগুলোর মনেও বিশ্বাসের সঞ্চার করেছে এই সিরিজ জয়। নিষ্ঠা, সংকল্প আর জয়ের খিদে বাংলাদেশের সাফল্যের অন্তর্নিহিত রসায়ন। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে হয়তো আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে। তবে মোটা দাগে এই সিরিজ জয় বাংলাদেশর ক্রিকেটারদের হার না মানা মানসিকতার প্রতিফলন। আর সমর্থকদের স্বপ্নের নতুন দিগন্তের উন্মোচন।

advertisement

বাংলাদেশ ক্রিকেটে দর্শক বড় এক অনুঘটক। যারা ক্রিকেটের পাটীগণিত, জ্যামিতি, অথর্নীতি সবকিছু পাল্টে দেয়! এদের জীবনে কত ঘাত-প্রতিঘাত। কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে কত স্বপ্ন! জীবনের কত দুঃখ ভুলে এরা ক্রিকেট ঘিরে কত সব সোনার দিনের স্বপ্ন দেখতে পারেন! এক সময় এ দেশের হতদরিদ্র মানুষের কাছে ক্রিকেট সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একটা বস্তু ছিল। এখন সেই ক্রিকেট অনেকের জীবনের গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। অনেকের অস্তিত্ব রক্ষার হাতিয়ার।

ফুটপাতে শুয়ে ক্রিকেট নিয়ে সোনার দিনের স্বপ্ন দেখার লোকের অভাব হবে না এ দেশে। ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করবে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর আগে অনেকের কল্পজগতের দরজার কড়ায় এই চিন্তা নাড়া দেয়নি। কিন্তু সিরিজ শেষে সেটাই বাস্তব হলো! বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন এই গল্পে দেখা গেল সাকিবের দলের অসম্ভব স্পিরিট। সবর্স্ব পণ করে লড়াই এবং জয়।

সিরিজের শেষ এবং তৃতীয় ম্যাচে দেখা গেল এক পর্যায়ে হারের কিনারের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রচণ্ড টেনশন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। তার পর সাফল্যের প্রতিক্রিয়া। সেখানেও খানিকটা শান্ত এবং ভাবলেশহীনভাবে বাংলাদেশ অধিনায়ক বলে গেলেন নিষ্ঠা, সংকল্প থাকলে এটা সম্ভব।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এ রকম সিরিজ জয়েও কিছু খুঁত আছে। বড় জয়ের ক্যানভাসে সাদা চোখে সেগুলো হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথবা অনেকে খুঁজতে চাইবে না। গৌরবের লগ্নে অনেক অপ্রিয় কথা অনেকে লিখতে চাইবেন না। বলতে চাইবেন না। অনেকে শুনতেও চাইবেন না। কিন্তু ক্রিকেট সাফল্যের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে এগুলো শুনতে হয়।

বাংলাদেশ দাপটের সঙ্গে সিরিজ জিতল। কিন্তু নিজের মাঠে এটা আর যাই হোক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের খুব ভালো বিজ্ঞাপন হতে পারে না। মানুষ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রান দেখতে চান। বড় স্কোর চান। সেই রান তাড়া করে জিতছে সে রকম নাটকীয় অনেক কিছু দেখতে চান তারা। কিন্তু বড় স্কোর হলো কোথায়। সর্বোচ্চ রান হলো ১৫৮! যেখানে খেলা হলো সেই বাইশ গজকে নিখাদ টি-টোয়েন্টি উইকেট বলে দাবি করা যাবে না। আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে অনেক বেশি স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হবে। সেখানে ভালো করার চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে।

বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আপনি নাও হতে পারেন। তবে ভালো ক্রিকেট টিম হোম অ্যান্ড অ্যাওয়েতে ভালো পারফরম্যান্স করে। হোমে ভালো করল বাংলাদেশ। অ্যাওয়েতে প্রমাণ করার দায়িত্ব এখন সাকিব-লিটন-শান্ত-মেহেদী-তাসকিন-হাসানদের। সেখানে অবশ্য আশাবাদী হওয়ার কিছু আভাস আছে। সাকিব পারফরম করে চলেছেন। শান্ত ধারাবাহিক হতে চেষ্টা করছেন। রানে ফিরেছেন লিটন। ডোনাল্ডের ছোঁয়ায় দারুণ ছন্দে তাসকিন। মেহেদীর সাফল্যের ক্ষুধা প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হচ্ছে। মোস্তাফিজের নিজেকে হারিয়ে খোঁজার দিন মনে হয় ফুরাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষও দলটাকে নিয়ে আশাবাদী হতে চাইছে। চারদিকের অবিশ্বাসের মধ্যেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটার সামর্থ্য আর যোগ্যতা নিয়ে মানুষের খুব বেশি সংশয় নেই। সাফল্যের পাশাপাশি এই দলটার কাছে দর্শকরা আনন্দও প্র্যতাশা করে। সেই প্রত্যাশার চাপটাও কম নয়। সেটাকেও সামাল দিতে হবে ক্রিকেটারদেরই। ‘আমরা টি-টোয়েন্টিতে এখনো তেমন ভালো দল নই’ এই বাক্য বলে পার পাওয়ার দিনও কিন্তু ফুরিয়ে গেল। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে একটা, দুটো নয়, টানা তিনটা ম্যাচ জিতলেন। এখন কীভাবে বলবেন, আমরা তেমন ভালো দল নই! জনপ্রত্যাশা আর মিডিয়া মিলে বাড়তি একটা চাপ কিন্তু তৈরিই হলো।

ক্রিকেট নিয়ে উদ্দীপনার অস্বীকৃত একটা যন্ত্র হচ্ছে দর্শক। চট্টগ্রামে সেই দর্শক ঘাটতি ছিল। যা খানিকটা বিস্ময়কর। কিন্তু ঢাকায় কর্মদিবসেও দুপুর তিনটায় শুরু হওয়া ম্যাচে দর্শকের কমতি ছিল না! ঢাকায় দর্শকদের আবেগের স্রোতধারা চলমান ছিল। প্রতিটি জয়ের পর উন্মদানাও ছিল।

গ্যলারিতেও যেন একটা টোন সেট করা ছিল এবার। ‘ঝাঁপাও, কাঁপিয়ে দাও বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। সেই সঙ্গে নিজেদের খাদ্য চিনতে ভুল করো না!’ সত্যিই সাকিবরা খাদ্য চিনতে ভুল করেননি। বিজয়ের উন্মাদনায় তারা এগিয়ে গেছেন। চট্টগ্রামে তৃতীয় ওয়ানডে জয়ের পর দারুণভাবে বদলে যায় বাংলাদেশ দলটা। আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে যায়। ক্রিকেটারদের শারীরিক ভাষা বলছিল, ‘বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তো কী! নিজেদের লক্ষ্যের ওপর বিশ্বাস রাখো। কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’ সেটা প্রমাণও করলেন তারা।

বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ হিসেবে হাতুরাসিংহের প্রত্যাবর্তনেই এটাÑ এখনই এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ইংলিশদের বিপক্ষে এই সাফল্য টিম স্পিরিটে। আর এই স্পিরিট স্কিলের পার্থক্য ঢেকে দেয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেটাই হলো। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়। তাও হোয়াইটওয়াশ করে! বাংলাদেশ ক্রিকেটে ইতিহাস। সাকিব আল হাসান ইতিহাসে বিশ্বাসী। তবে ইতিহাসে পড়ে থাকা লোক নন। ইতিহাস তৈরিতেই বিশ্বাস। তার সেই বিশ্বাস গোটা দলে ছড়িয়ে পড়লে, না চাইলেও পাঠক, দর্শকের ইতিহাসের পাতা ওল্টাতেই হবে।

অঘোর মন্ডল : সাংবাদিক, কলাম লেখক