জনসংখ্যা বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে ঘরবাড়ির চাহিদা। ওই চাহিদা মেটাতে গিয়ে কমছে কৃষিজমি। বড় শহরের আশপাশে ফসলের মাঠে বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পের সাইনবোর্ডের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, বাড়ছে রাস্তাঘাটের চাহিদা। একই সঙ্গে গড়ে উঠছে নানা ধরনের শিল্প-কারখানা। ফলে প্রতিনিয়ত কমছে কৃষিজমি। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে ইটভাটা। এসব ইটভাটায় মাটির জোগান দিতে গিয়ে বদলে যাচ্ছে কৃষিজমির ধরন। কমছে জমির উৎপাদনক্ষমতা।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, কুমিল্লার গোমতী নদীর চরজুড়ে কোদালের পাশাপাশি ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। ট্রাক্টরে মাটি পরিবহন করা হচ্ছে। এসব মাটির ৯০ শতাংশই যাচ্ছে ইটভাটায়। এই সময়ে আগে যে চর ছেয়ে থাকত আলু, মুলা, কপি ইত্যাদি সবজিতেÑ সেখানে এখন সবুজের কোনো ছোঁয়া নেই। এভাবে মাটি কাটার ফলে গোমতীর প্রতিরক্ষা বাঁধও হুমকির মুখে। কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আশঙ্কা করছেÑ এ বছর যেভাবে মাটি কাটা হচ্ছে, এতে চরের অন্তত ৭০০ একর ফসলি জমি হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষি শুমারি ২০১৯-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গড়ে প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে ৩৭ হাজার ৮১৮ একর। গত ১১ বছরে আবাদি জমি কমেছে ৪ লাখ ১৬ হাজার একর। তার পরও উপকূলীয় এলাকায় নোনা পানির অনুপ্রবেশের কারণে জমির উর্বরতা কমছে, কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া জোরদার হচ্ছে। তামাক চাষের মতো কিছু ‘লাভজনক’ ফসল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য জমির পরিমাণ কমাচ্ছে। জাতীয় কৃষিনীতি ১৯৯৯-এ অকৃষি খাতে কৃষিজমির ব্যবহারকে নিরুৎসাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া কৃষিজমি সুরক্ষা সংক্রান্ত বেশকিছু আইন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের আশুপদক্ষেপ প্রয়োজন।
নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। ইট তেমনই একটি নির্মাণসামগ্রী। ইট উৎপাদনের আরও পন্থা রয়েছে। পরিবেশসম্মত ইট উৎপাদনের উদ্যোগ কম বলেই কৃষিজমিতে আঘাত আসছে বেশি করে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, সারাদেশেই চলছে এভাবে কৃষিজমি হ্রাসের সর্বনাশা প্রক্রিয়া। কুমিল্লায় এই প্রবণতা বেশি জোরদার। এর আগে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা গেছে, শুধু মুরাদনগর উপজেলায় পৌনে ২০০ ভেকু বা মাটি খননকারী মেশিন রয়েছে। ২০-২৫ ফুট পর্যন্ত গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে। একইভাবে গোমতীসহ বিভিন্ন নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে নদীভাঙনের পরিমাণ এবং কমছে কৃষিজমি।
আমরা মনে করি, কৃষিজমি রক্ষায় আরও কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তা যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিজমি থেকে মাটি কাটার এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ যে হারে দূষণ হয়, সেটি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ইটভাটার নির্গত ছাই পার্শ্ববর্তী নদী বা জলাশয়ে নিষ্কাশিত হয়। ওই বর্জ্য পানিতে মিশে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত উপাদান যেমনÑ লেড, ক্যাডমিয়াম, জিংক, ক্রোমিয়াম জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলের দ্বারা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইটভাটার সৃষ্ট দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বয়স্ক ও শিশুরা।
ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হয় জ্বালানি কাঠ। এতে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। অধিকাংশ ভাটায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ইট পোড়ানো কার্যক্রম। শুধু কি কাঠ? সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে কৃষিজমির উর্বর মাটিও। একশ্রেণির অসাধুচক্র কৃষিজমির মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে ইটভাটায় বিক্রি করে। এ ক্ষেত্রে জমির মালিককে জৈবসার কেনা বাবদ সামান্য কিছু অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। এই চক্র ভুলভাল বুঝিয়ে জমি খুঁড়তে কৃষকদের রাজি করান। মাটি ব্যবসায়ীরা এ বছর যে জমির মাটি তুলে নেন, ঠিক তার পরের বছর পাশের জমির মালিকদেরও একই বুঝ দিয়ে কব্জায় নেন। কারণ সব সময় পানি ও পলি নিচু জমিতে নেমে যায়। ফলে এ ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হন পাশের জমির মালিকরাও। এভাবেই ফসলি জমির প্রাণ কেটে নিয়ে প্রতিনিয়ত ইটভাটায় পোড়ানো হয়। কৃষকরা তাদের চটকদারি কথায় রাজি হয়ে জমি খুঁড়ে মাটি দেন ইটভাটায়। ভাটা মালিকরা এসব মাটি নিয়ে তৈরি করেন ইট। এতে মালিকরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন চাষিরা। ফলে উৎপাদন কমে গিয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে লালমনিরহাট জেলার কৃষিজ ফলন। শুষ্ক মৌসুমে ইটভাটার জন্য জমির উপরি অংশের ২-৩ ফুট পর্যন্ত মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। জমির উপরি অংশের নরম মাটিই সবচেয়ে উর্বর। আর এ উর্বরা শক্তিই কেটে নিয়ে পোড়ানো হয় ইটভাটায়। এ কারণে দিন দিন কমতে শুরু করেছে কৃষিজাত ফসলের ফলন।
অসাধু মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু বাস্তবে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বা জরিমানা করেও কৃষিজমির মাটি রক্ষা করা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, অসাধু ব্যবসায়ীদের যথোপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
দিলীপ কুমার আগরওয়ালা : পরিচালক, এফবিসিসিআই; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড