advertisement
advertisement
advertisement

বঙ্গবন্ধু, বাঙালির আত্মপরিচয়ের আরেক নাম

সুমনা গুপ্তা
১৭ মার্চ ২০২৩ ০৭:১১ পিএম | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৩ ০৭:১১ পিএম
সুমনা গুপ্তা। ফাইল ছবি
advertisement

বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা, অহঙ্কারের সাতকাহন, আত্মমর্যাদার প্রতীক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি শুধু বাঙালির জাতির পিতাই নন, আপামর মানুষের বন্ধু, বঙ্গবন্ধু। আজ এই মহতী মানুষটির জন্মদিন। আর, তার জন্ম না হলে হয়তো ইতিহাস ভিন্ন হতো। আর ঊনসত্তর, একাত্তর হয়ে আজও তিনি অবিনশ্বর, অবিচল এক মহীরুহ। তারই আদর্শে এই প্রজন্মও দেশপ্রেমকে বুকে ধারণ করে পথ চলে।

‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি’ কথাগুলো আমার নয়। বলেছিলেন কিউবার অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ট্রো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শারীরিকভাবেও ছিলেন বিশালাকায়। গড়পড়তা বাঙালিদের চেয়ে ছিলেন বেশি উচ্চতা। আর তার প্রবল ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের চেয়েও বিশাল। যে ব্যক্তিত্বের সামনে মাথা নত করতে হয়েছিল প্রবল প্রতাপশালী পাক জেনারেলদেরও।

advertisement

এ দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জ্বলজ্বলমান যে নামটি, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ বছরের গোলামির জিঞ্জির ভেঙে তার ডাকেই ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল দুর্গ। হাজার হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকেও তিনি ছিলেন মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং ক্যাম্প আর শরণার্থীদের রিফিউজি ক্যাম্পের মানুষগুলোর হৃদয় মাঝে ভাস্বর হয়ে। তার নামেই উজ্জীবিত হয়ে জীবন বাজি রেখে এক মুহূর্তের জন্যও কুণ্ঠিত হয়নি বাঙালি। সেই উজ্জীবনাকে জাগিয়ে রাখতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার শব্দসৈনিকদের কণ্ঠে ঘোষণা ভেসে আসত

‘বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথেই আছেন’
যুদ্ধ চলাকালীন এই গানটি হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রাণে শক্তির সঞ্চার করেছিল
‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি/
আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি/
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’
এই গানটি প্রেরণা জোগাত, আশার সঞ্চার করত মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে।
প্রশিক্ষণ শিবিরে গেরিলারা হাতিয়ার তুলে বজ্রনিনাদে স্লোগান তুলতেন
‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব,
মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’

advertisement

অবস্থা এ রকম চরম বিপরীতে চলে যাবে তা জল্লাদ ইয়াহিয়ার মতো মানুষও ধারণা করতে পারেনি। শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিলে পূর্ববাংলার আপামর জনগণের বর্তমানের শান্ত পরিস্থিতি তো উত্তাল হবেই, বাঙালির চিন্তার জগতে, ভাবনার ভুবনে, মেধার উৎকর্ষে কিংবা ভরসার আশ্রয়স্থল হিসেবেÑ সব স্থানেই খুঁজে পায় বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বকে। আর এরই ধারাবাহিকতায়, ৫২-এর টগবগে তরুণ মুজিব ৬৬ বা ৬৯ ছাড়িয়ে হয়ে যান বঙ্গবন্ধু, ’৭১-এর ৭ মার্চে হ্যামিলনের বংশীবাদক, ২৫ মার্চের ঘোর অন্ধকারে পুরোদুস্তুর এক জাদুকর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংকের সামনে, অবুঝ কিশোর তাজা রক্তের আখরে লিখে যায় মাতৃভ‚মির রক্তঋণ শোধ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা কিংবা অশ্রæসজল জননী প্রাণপ্রতিম সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দেন অবলীলায়, আবালবৃদ্ধবনিতা লিপ্ত হয়ে পড়ে সর্বাত্মক এক জনযুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পরাধীন বাংলার রাজনৈতিক আকাশের ঊজ্জ্বলতম নক্ষত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্বনন্দিত নেতা। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ ডামাডোল আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়েও বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথার্থই বলেছিলেন

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।/দিকে দিকে আজ অশ্রæগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস রচনা করেছে হাজার বছরের শৃঙ্খল মোচনের এক অমর মহাকাব্য। তিনি প্রোজ্জ্বলিত এক নক্ষত্র, অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রস্ফুটিত গোলাপ। বাঙালি বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন, তিনি বাঙালির চেতনার রাজ্যে মুকুটহীন রাজা, অপ্রতিদ্ব›দ্বী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

স্বাধীনতার পর পাক হানাদার বাহিনীর বন্দিশালা থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথম যেদিন স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন, তিনি সেদিন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা, মাটি ও মানুষ, রক্ত ও লাশের স্তুপ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। তিনি কেঁদেছিলেন। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তার বুকে ছিল এক সাগর ভালোবাসা। অশ্রু ঝরছিল সেদিন এই স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যা তার বুকের গভীরে আঁকা ছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুভ‚তি ও অন্তর আত্মায় মিশে আছেন।

বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানেই বাংলার মুক্ত আকাশ। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির অবিরাম মুক্তির সংগ্রাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমাদের ঋণ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অশেষ।

কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট দেশি-বিদেশি চক্রান্তের শিকার হয়ে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে। বঙ্গবন্ধু কেবল লোকচক্ষুর সামনে থেকে অদৃশ্য হয়েছেন, হারিয়ে যাননি। হারাতে পারেন না কখনো। অলিতে-গলিতে, আকাশে-বাতাসে, চলাচলে সবখানে সবকিছুই জানান দিচ্ছে মুজিব আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আছেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের আসনে। আজ তাঁর জন্মতিথিতে বছর রাস্তাঘাটে মানুষের এত স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ জানান দিয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের অন্তরে কীভাবে গেঁথে রয়েছেন।

সমগ্র পৃথিবী অবাক হয়েছিল পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট, কারণ যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাহস করেনি পাকিস্তান, সে বাঙালিপাগল বঙ্গবন্ধু প্রাণ দিয়েছেন তারই বাঙালির হাতে। প্রাণ দিয়েছেন তার পুরো পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ প্রায় ২৯ জন মানুষ সবাই। নিজের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য হয়তো ইতিহাস কখনই বাঙালি জাতিকে ক্ষমা করবে না। একাত্তরে যে বীর বাঙালি শব্দটি উচ্চারিত হতো, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর এর পাশে কলঙ্কিত ‘বেইমান’ শব্দটি সংযোজিত করেছে ঘাতক মোশতাক। পাকিস্তানিদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেছিল বেইমান মোশতাক। ’৭১-এর হায়েনা পরাজিত শকুনদের পথ দেখিয়েছে মোশতাক, যারা বাঙালির বিজয়ে গর্তে লুকিয়ে ছিল।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা থেকেই উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি
‘মুজিব মরে না, মরেনি মুজিব কোনো বুলেটের ঘায়।
বুলেটে পতিত দেহই কেবল, অমর সে আত্মায়।
অবিরাম হেঁটে চলেছে মুজিব রক্তচাদর গায়,
মুজিব, মুজিব, জনকের নাম, এত সহজে কি মোছা যায়?’
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত প্রাণপুরুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে তাঁর পুণ্য স্মৃতির প্রতি জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সুমনা গুপ্তা : শিক্ষক ও গবেষক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়