advertisement
advertisement
advertisement

স্বতন্ত্র পরিচালকরা কি হতে পারবেন ব্যাংকের রক্ষাকবচ

মাহফুজুর রহমান
১৮ মার্চ ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪১ এএম
advertisement

বাংলাদেশে ব্যাংক পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ এ বিষয়ক চিন্তাবিদরা সন্তুষ্ট নন, এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা কর্তৃক নয়ছয় করার নানা ধরনের তথ্য বিভিন্ন সময়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারী ও বিধিবহির্ভূত মনোভাব ব্যাংকগুলোকে লোকসানের মুখে ফেলেছে এবং কোনো কোনোটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সমস্যা যখন পাকাপোক্ত রূপ নিয়েছে তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও অনেকটা বাধ্য হয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে। একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের সভায় যখন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহীতব্য জটিল কোনো সিদ্ধান্ত নিজেরাই গ্রহণ করে সেখানে উপস্থিত গভর্নর সমীপে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং পরদিন কোনোরূপ গবেষণা ছাড়া হুবহু হোটেলে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক সার্কুলার জারি করা হয় তখনই রেগুলেটরের মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছিল- এ কথা সবাই জানেন। এ ধরনের গৃহপালিত রেগুলেটরকে হাতে পেয়ে ব্যাংকের পরিচালকরা ‘যেমন খুশি তেমন করো’ পদ্ধতিতে ব্যাংক চালিয়েছেন। আর এরই ফলে ব্যাংক পরিচালনা নিয়ে কর্তৃপক্ষকে নানা বিষয় ভাবতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে ব্যাংক কীভাবে পরিচালনা করা হয়? একটি ব্যাংকের জন্মের পর উদ্যোক্তারা একটি পরিচালনা পর্ষদ মনোনয়ন প্রদান করেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন প্রদান করে। আবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তথা সরকার ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক নিয়োগ করে থাকে; তবে এ ক্ষেত্রেও আইন রক্ষার প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি আনুষ্ঠানিক অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা হয়ে থাকে। তারা বোর্ড সভায় বা ক্ষেত্রমতো নির্বাহী কমিটি ও অডিট কমিটির সভায় উপস্থিত থাকেন।

advertisement

সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) কর্তৃক আয়োজিত নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায় সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালকরা দায়িত্ব গ্রহণ করেই নিজেদের ব্যাংকের মালিক ভাবতে শুরু করেন। তিনি আরও বলেছেন, নৈতিকতা ও সুশাসন ব্যাংকিংয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্যাংক খাতে এর কিছু ব্যত্যয় ঘটছে। কিছু ব্যাংকের পরিচালক নিজেদের ব্যাংকের মালিক মনে করছেন। আবার কিছু ব্যাংকার তাতে সহায়তাও করছেন।

নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতার এবারের বিষয় ছিল ‘এথিকস অন ব্যাংকিং’। মূল প্রবন্ধ পাঠক গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) সাবেক পরিচালক একেএম সাইফুল মজিদ তার প্রবন্ধে বলেছেন, অস্বাস্থ্যকর করপোরেট সংস্কৃতির কারণে গত চার দশকে আর্থিক খাতের পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংকারদের লোভী মানসিকতা এবং বেসিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে আমানতকারী ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি প্রকট হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর করপোরেট সংস্কৃতি বলতে তিনি লোভ, করপোরেট ব্যবস্থাপনার রাজনৈতিকীকরণ, বেমানান ও সংঘর্ষ সৃষ্টিকারী সংস্কৃতিকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, গত চার দশকে কয়েকটি পরিবার ও কিছু ব্যাংকার প্রতারণামূলক কাজ ও বিদেশে অর্থ পাচার বাড়িয়েছে। ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার চর্চা থাকলে ব্যাংকের অংশীজনদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। বিশেষত গ্রাহক ও মালিকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়।

advertisement

ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়েও প্রবন্ধ উপস্থাপক বক্তব্য রেখেছেন। তার মতে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে লোভী ব্যাংকার, সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। সবশেষে একেএম সাইফুল মজিদ ব্যাংক পরিচালনায় শেয়ারধারীদের চেয়ে আমানতকারীদের বেশি বেশি গুরুত্ব প্রদান করার পরামর্শ প্রদান করেছেন।

আমানতকারীদের ব্যাংক পরিচালনায় অধিক গুরুত্ব প্রদান করার অর্থ হলো স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের অধিক ক্ষমতা প্রদান করা। ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করার ইচ্ছে ও আগ্রহ নিয়ে যারা ব্যাংকের লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন এবং অনেক ধরনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংক ব্যবসা শুরু করেছেন তাদের বাদ দিয়ে ব্যাংকে যারা আমানত রাখতে এসেছেন তাদের পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করার এই প্রস্তাব এলো কেন? ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১১০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক-কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, নিরীক্ষক, অবসায়ক, ম্যানেজার এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী চবহধষ ঈড়ফব, ১৮৬০ (অপঃ ঢখঠ ড়ভ ১৮৬০) এর ঝবপঃরড়হ ২১-এ যে অর্থে জনসেবক (চঁনষরপ ঝবৎাধহঃ) কথাটি ব্যবহৃত হইয়াছে সেই অর্থে জনসেবক (চঁনষরপ ঝবৎাধহঃ) বলিয়া গণ্য হইবেন।’

এখানে এটাই স্পষ্ট যে, ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক থেকে শুরু করে একজন সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে একজন জনসেবক, কোনো অবস্থাতেই মালিক নন। অথচ গভর্নরের বক্তব্য অনুসারে এসব পরিচালকের আচরণ ব্যাংকের মালিকের মতোই হয়ে উঠেছে। তাই আমানতকারীদের ব্যাংক পরিচালনায় অধিক সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব এসেছে।

এ ধরনের প্রস্তাব যে শুধু নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতার মুখ্য আলোচকই করেছেন তা নয়। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ব্যবসা সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান কর্তৃক সঞ্চালিত ‘দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা একই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বক্তারা বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালকদের ব্যাংকে শেয়ার থাকে না। তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য। তবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় দেখা যাচ্ছে, চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালী পরিচালকদের আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এবং এসব স্বতন্ত্র পরিচালক কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না। বক্তারা বলেছেন, স্বতন্ত্র পরিচালক ও প্রতিনিধি পরিচালক যেসব ব্যাংকে বেশি, সেই ব্যাংকগুলোতে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। কারণ, সুবিধা নেওয়া ছাড়া এসব পরিচালক কোনো ভূমিকা রাখছেন না।

ব্যাংকের যারা শেয়ারহোল্ডার তারা ব্যাংক থেকে লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। কিন্তু একজন স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যাংক থেকে লভ্যাংশ পান না। ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে তারা প্রতিটি সভায় অংশগ্রহণের জন্য আয়কর কর্তন বাদে মাত্র ৭ হাজার ২০০ টাকা পেয়ে থাকেন। এজন্য তাকে অনেকগুলো মেমো পড়ে, আনুষঙ্গিক বিষয়াদি জেনে প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হয়। সভার দিন পর্ষদ সদস্যরা সারাদিনই সভার কাজে ব্যস্ত থাকেন। পরিচালক হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হলে একজন পরিচালককে প্রায় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর এর বিনিময়ে সপ্তাহে মাত্র ৭ হাজার টাকা খুবই অপ্রতুল। এই টাকার বিনিময়ে দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংক পরিচালনা করতে কেউ রাজি হবেন বলে মনে হয় না।

এ ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের দায়িত্ব কার ওপর ন্যস্ত থাকবে? এটা নৈতিকভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কাউকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে এবং সেই ব্যক্তি যদি কোনো অনিয়মে জড়িত হয় তা হলে এজন্য কে দায়ী হবে? অন্যদিকে ব্যাংকের শেয়ারমালিকদের হাতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের দায়িত্ব থাকলে বর্তমান অবস্থার মতোই ভাই-মামাতো ভাই নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে; এটা রোধ করা যাবে না। আবার স্বতন্ত্র পরিচালকরা যেহেতু আমানতকারীদের স্বার্থ দেখবেন, তা হলে তাদের নিয়োগের দায়িত্ব কি আমানতকারীদের ওপর প্রদান করা হবে। এটাও বাস্তবসম্মত নয়। সুতরাং বর্তমানে যা আছে তাই শেষ পর্যন্ত বহাল থাকবে।

ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব সর্বত্রই উদ্যোক্তাদের। বাংলাদেশেও উদ্যোক্তারাই পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন। এই উদ্যোক্তা পরিচালকদের চেয়ে মালিকানাহীন স্বতন্ত্র পরিচালকরা এসে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করবেন এ কথা অনেকটাই অলীক কল্পনা বলে মনে হয়। তাই ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদেরই ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান বহাল রাখতে হবে। তবে রেগুলেটরসহ সরকারি অন্যান্য সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়ে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা বা ভাই-মামাতো ভাই বিবেচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে পরিচালকদের আইন পালনে বাধ্য করতে হবে। ঋণগ্রহীতাদেরও কোনো ছাড় না দিয়ে কঠোরভাবে ঋণ আদায় কার্যক্রম পরিচালনা ও সহায়তা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাই বর্তমান সময়ের এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে আর্থিক খাতকে উদ্ধার করতে পারে।

মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক