ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ২০ বছর
আজ থেকে ২০ বছর আগে এই দিনে ইরাকে সর্বাত্মক আগ্রাসন চালিয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন জোট। সেদিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাত দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সেই যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। আরেকটি যুক্তি ছিল- সাদ্দাম হোসেনের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ রয়েছে। আজ ২০ বছর পর দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেÑ সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপটি ছিল ‘ভুল’ আর ‘ব্যয়বহুল’, যা লাখো ইরাকির রক্ত ঝরিয়েও আজও শোধরানো যায়নি। যদিও মার্কিন সংবাদমাধ্যম আটলান্টা বলছে, সেই ভুলের পরও ইরাক যুদ্ধকে এখন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সেখানে যুদ্ধ বাঁধিয়েছিল। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, ইরাকে গণতন্ত্র কাজ করছে না; কিংবা সেখানে নির্বাচনও সুষ্ঠু হচ্ছে না। যদিও সরকার নির্বাচনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সেটি অকার্যকর, অস্থিতিশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছ। সর্বশেষ ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক বছরের মাথায়ও ঠিকমতো প্রশাসন গঠন করতে পারেনি।
মার্কিন প্রশাসন আরেকটি আশা করেছিল যে, ইরাকে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে সেই সূত্র ধরে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও সেই বাতাস বইবে। কিন্তু সেই আশা দ্রুতই হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ইরাকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং এর পরই সেটি লিবিয়া ও সিরিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রবলভাবে উত্থান হয় তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস। বর্তমানে ব্রিটেনের চেয়েও বৃহৎ অঞ্চল নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ার ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করে তারা। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’ দেখা দেয়। এতে লাখ লাখ শরণার্থী ইউরোপের দিকে ধাবিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধটিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। ইরাকে হতাহতের মধ্যেই হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। কিন্তু সেই সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরাক যুদ্ধে বিরোধিতা করে ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে বড় সমর্থন আদায় করেন।
সবচেয়ে শোচনীয় বিষয় হলো যুদ্ধটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের উভয়পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ইঙ্গ-মার্কিন জোটের চার হাজারের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন এবং কয়েক হাজার সেনা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন। অন্যদিকে এক লাখ ইরাকি নিহত হয়েছেন। মার্কিন খতিয়ান অনুযায়ী ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ইরাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সভ্যতার অনেক কিছুই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে মার্কিন বাহিনী।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান এক মার্কিন মেরিন সেনার ভাষ্য তুলে ধরেছে, সেখানে ওই সেনা বলেছেন, আমরা যখন বাগদাদ যাচ্ছিলাম, সেই সময় আমরা শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা অবশ্যই সঠিক কারণে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আপনি যখন একজন তরুণ সেনা, সেই সময় আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে, সরকার আপনার সঙ্গে মিথ্যচার করছে বা আপনাকে এমন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাচ্ছে, যার প্রয়োজন ছিল না।
ওই মেরিন সেনা আরও বলেন, যখন ইরাকি সেনারা শুধু খাবার ও আশ্রয়ের জন্য আত্মসমর্পণ করছে এবং নারী-পুরুষ-শিশুরা হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে সেই সময়Ñ আপনি যা বোঝার বুঝে গেছেন। কিন্তু পরে যখন রাতের অন্ধকারে ইরাকিরা আপনার ওপর হামলা করে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, যারা আপনার দিকে হাসছিল, তারাই আবার আক্রমণ করেছে। এটি অত্যন্ত বাজে ব্যাপার শয়তান জনতা।
প্রসঙ্গত, মার্কিন বাহিনী যখন ইরাকে আক্রমণ করেছিল, সেই সময় কিছু ইরাকি মার্কিন বাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারা মার্কিন বাহিনীকে মুক্তিদাতা মনে করেছিল। সেই সেনারাই সাদ্দাম হোসেনের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। সেই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মনে করতেন, ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই সেটি রক্তাক্ত বিভ্রান্তিতে পরিণত হয়েছিল। যে রক্তপাত আজও বন্ধ হয়নি, সেই স্থিতিশীল ইরাকের স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি।