advertisement
advertisement
advertisement

ইরাক আক্রমণের ২০ বছর
আমেরিকার নতুন প্রজন্ম কি অনুতপ্ত

আন্দ্রে স্ট্যান্টন মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক

জাহাঙ্গীর সুর
১৯ মার্চ ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৩ ১১:৪৬ পিএম
আন্দ্রে স্ট্যান্টন
advertisement

মার্কিন ইতিহাসবিদ। সম্প্রচারমাধ্যম ও জাতিগত পরিচয় তার গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। ইসলামিক অধ্যয়নের একজন পণ্ডিত। আমেরিকায় সম্প্রচারমাধ্যমগুলোয় কীভাবে ইসলামবিদ্বেষী ভাষ্য ও আধেয় ছড়িয়ে পড়ে, তা নিয়ে কাজ করেন তিনি। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারে। তার এ নিবন্ধটি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে দ্য কনভারসেশনে। অনুমতি নিয়ে তা অনুবাদ করেছেন আমাদের সময়ের সহকারী সম্পাদক জাহাঙ্গীর সুর

যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর আগে ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ইরাক আক্রমণ করেছিল। আগ্রাসন চালানোর কারণ হিসেবে তারা দাবি করেছিল, গণবিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবহার থেকে ইরাকি সরকারকে নিরস্ত্র করা এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানো জরুরি।

advertisement

মার্কিন সেনারা ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে সাদ্দামকে বন্দি করে। অন্যদিকে ১৫ মাসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইরাকের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। কিন্তু পশ্চিমাশক্তি ও ইরাকের মধ্যে দ্বন্দ্ব ২০১১ সাল পর্যন্ত চলেছিল। যুদ্ধে চার হাজার ছয়শর বেশি মার্কিন সেনা মারা গিয়েছিল, কয়েক হাজার সেনা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পর আত্মহত্যা করেছিল।

আমেরিকার আক্রমণের পর ইরাকি যুদ্ধ সম্পর্কিত সহিংসতায় যোদ্ধা ও বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত ২ লাখ ৮৮ হাজার জন মারা গেছেন (কোনো কোনো পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা চার লাখ পাঁচ হাজার পর্যন্ত)। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এক লাখ কোটি ডলারের বেশি খরচ হয়েছে।

advertisement

ইরাক এখনো পরস্পরবিরোধী ধর্মীয়-রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো ও অস্থিতিশীল সরকারের মধ্যকার ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলা করে যাচ্ছে।

এসব সমস্যার বেশিরভাগই উদ্ভূত হয়েছিল যুদ্ধ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন এবং তার পরের যুদ্ধ উভয় দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক তরুণের চোখে যুদ্ধ ও বর্তমানে ওই যুদ্ধের প্রভাবের মধ্যকার সম্পর্কটি স্পষ্ট নয়। তাদের কাছে যুদ্ধ যেন কেবলই অতীতের একটি নিদর্শন মাত্র।

আমি মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ইতিহাসবিদ ও ইসলামিক অধ্যয়নের পণ্ডিত। ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ ও ইরাক যুদ্ধ বিষয়ে (ইউনিভার্সিটি অব ডেনভার) দুটি স্নাতক কোর্স পড়াই। আমার কোর্সগুলো এমন শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করেÑ যারা রাজনীতি, আইন, সরকার ও অলাভজনক সংস্থায় কাজ করার আশা করেন এবং যাদের ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্য, অভিবাসন ইতিহাস ও জাতিগত পরিচয় জড়িয়ে আছে।

অতীতের অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহ যেমন করে তাদের প্রভাবিত করে, তেমনি ইরাক আক্রমণ ও এর ফলে পরবর্তী যুদ্ধের গল্পগুলো এর থেকে বেশি একটা প্রভাব ফেলে না তাদের মননে। আক্রমণ ও যুদ্ধের গল্প থেকে তারা শিখতে চায়। কিন্তু নিজেদের জীবনের সঙ্গে এগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ যোগ তারা সেভাবে ধরতে পারে না।

একটি প্রজন্মগত পরিবর্তন

ইরাক যুদ্ধ বিষয়ে কোর্স পড়ানো শুরু করেছি ২০১০ সালে। আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহস্রাব্দের প্রজন্ম ছিল। এখন ‘জেনারেশন জেড’-এর ছেলেমেয়েদের পড়াই। তাদের জন্ম ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০-এর দশকের প্রথম ভাগের মধ্যে। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনসহ ২১ শতকের প্রথম দিকের প্রধান ঘটনাগুলো কীভাবে এই ছাত্ররা বোঝে, এতেও একটি পরিবর্তন দেখেছি।

সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ টেলিভিশনে ইরাক আক্রমণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ক্লাসে পড়ানোর সময় এ রকম বিষয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেষ্টা করি।

আমার জীবনের যে অভিজ্ঞতা, এর থেকেও তাদের শেখাই। যেমন ২০০৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির কথা বলি। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছে, এটা অনুমান করতে পেরে প্রতিরোধের প্রচেষ্টা হিসেবে সেদিন বিশ^ব্যাপী ছয়শর বেশি শহরে যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। ক্লাসে এ কথা তুলে ধরি। আমি আলোচনা করি বস্তুগত সংস্কৃতির দিকগুলো। যেমন তাস খেলার ডেকের কথা বলিÑ যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইরাকি মোস্ট ওয়ান্টেড’। ইরাকে নিয়োজিত মার্কিন সামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে ওই ডেক বিতরণ করা হয়। তারা এই কার্ড দিয়ে তাস খেলত। একই সঙ্গে ইরাক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে সাহায্য করত এসব কার্ড (এগুলোঢ ৫২ জন মোস্ট ওয়ান্টেড ইরাকির মুখচ্ছবি অঙ্কিত ছিল)।

২০১০ সালের দিকে যে সহস্রাব্দ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের পড়াতাম, তারা কিশোর বয়সের স্মৃতি থেকে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের কথা স্মরণ করেছিল। এটা ছিল তাদের ব্যক্তিগত জীবনে বিভ্রান্তিকর; কিন্তু মৌলিক মুহূর্ত।

আজ জেড প্রজন্মের যে শিক্ষার্থীদের পড়াই, তাদের কাছে ইরাক আত্রমণ আর পাঁচ-দশটা যুদ্ধের ঘটনার মতো ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।

চিন্তার বিষয় বটে

ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন ও এর পরবর্তী যুদ্ধ সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান নিয়ে আমার কোর্সে পড়তে এসেছেÑ ২০১৫ সালের দিক থেকে এমন শিক্ষার্থী আর প্রত্যাশা করতে পারছি না। অথচ ২০১৩ সালেও আমার শিক্ষার্থীরা আমাকে জানাত, তাদের শৈশবে যুদ্ধরত যুক্তরাষ্ট্রের ছাপ রয়েছে। তবে সেসব যুদ্ধ হচ্ছিল মার্কিন জমিন থেকে বহুদূরে।

আমার সহস্রাব্দ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ৯/১১ হামলা, আফগানিস্তান যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধকে তাদের জীবনে প্রভাব ফেলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করত। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের জঙ্গি হামলার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে আল কায়েদা ও তালেবানের আস্তানায় বিমান হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। তালেবান ৯/১১ হামলার মূল হোতা ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই অভিযান শুরু হয়। আর ২০২১ সালে আমার শিক্ষার্থীদের মনন কেমন ছিল? এ সময় তারা (অন্য দেশে) বুশের হস্তক্ষেপকে এক বিমূর্ত কৌতূহলের সঙ্গে বিবেচনা করেছিল।

১৯৫৭ সালে আইজেনহাওয়ার যে মতবাদ দিয়েছিলেন, ওই নীতি নিয়ে যতটা বিমূর্ত কৌতূহলÑ একই কৌতূহল তাদের বুশের কার্যনীতি নিয়ে। আইজেনহাওয়ার মতবাদে বলা হয়েছিলÑ অন্য দেশ দ্বারা একটি দেশ যদি হুমকির সম্মুখীন হয়, তা হলে হুমকির মুখে পড়া দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কাছে সাহায্যের অনুরোধ করতে পারে। পরের বছরই ১৯৫৮ সালে লেবাননে সামরিক হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দিতে এই আইজেনহাওয়ার মতবাদকে ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

আমার দিক থেকে বলবÑ প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ, ২০০০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুশের নেতৃত্ব, ৯/১১-এ হামলার পর আমেরিকার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও আফগানিস্তান আক্রমণ সম্পর্কে আগের থেকে এখন অনেক বেশি তথ্য-উপাত্ত আলোচনা করি ক্লাসে। যুক্তরাষ্ট্র কেন ইরাক আক্রমণ করেছিল এবং সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে বা বিপক্ষে আমেরিকানরা কেন এতটা দৃঢ়ভাবে সোচ্চার হয়েছিলÑ আমি মনে করি, এসব ঘটনা ও আলোচনা শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

ইরাক আক্রমণ দুই বছরের মধ্যে আমেরিকানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। ২০০৩ সালের মার্চে ৭১ শতাংশ আমেরিকান মনে করত, ইরাকে সামরিক শক্তি ব্যবহার করার যে সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছিলÑ তা সঠিক ছিল। দুই বছর পর ২০০৫ সালে যখন সবাই জেনে গেল ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র নেই, তখন আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষ নেওয়া মার্কিন নাগরিকের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৭ শতাংশে। এ কথা অবশ্য ঠিক, এই সমর্থকরা পরবর্তী জরিপগুলোতেও ইরাকে মার্কিন আক্রমণকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিল।

২০১৮ সালে আমেরিকার অর্ধেকের বেশি মানুষ বিশ্বাস করত, যুক্তরাষ্ট্র তার লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে ইরাকের যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে।

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

২০২১ সালের পিউ রিসার্চের জনমত জরিপ অনুযায়ী তরুণদের তুলনায় ৬৫ বছর বা এর বেশি বয়সী মার্কিন নাগরিকরাই সামরিক সুবিধা বজায় রাখাসহ যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে অধিক সোচ্চার। অন্যদিকে অল্পবয়সী আমেরিকানরাÑ যাদের বয়স ১৮ বছর থেকে ৩৯ বছর, তাদের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়া শীর্ষ সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে শরণার্থীদের সহায়তা প্রদান ও বিদেশে মার্কিন সামরিক প্রতিশ্রুতি সীমিত করা।

সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের ২০১৯ সালের এক জরিপ বলা হচ্ছে, সারাবিশ্বের গণতন্ত্র রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করা উচিত বলে বয়সী মার্কিন নাগরিকরা যতটা মনে করে, জেড প্রজন্ম অতটা মনে করে না; বরং তারা মনে করেÑ ‘মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধগুলো ছিল সময়, জীবন ও করদাতাদের অর্থের অপচয়।’ তারা এও মনে করে, এসব যুদ্ধ আমেরিকানদের নিজ দেশে নিরাপদ থাকতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাদের মত হলো, বিশে^ আমেরিকার স্বার্থকে এগিয়ে নিতে হলে সামরিক হস্তক্ষেপের পরিবর্তে বরং অর্থনৈতিক উপায় ও কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

এখন যারা স্নাতকের শিক্ষার্থী, কিছুদিন পরই তারা সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মজীবন শুরু করতে যাচ্ছে। এই শতকের শুরুর দিকের ঘটনাগুলোকে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরিবর্তে ঐতিহাসিক পাঠ হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা যেহেতু তাদের মধ্যে রয়েছে, সেহেতু আমি মনে করিÑ এই দৃষ্টিভঙ্গি পেশাদার সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের প্রভাবিত করতে পারে, তা তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হোক আর আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনেই কাজ করুক না কেন। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের মতো ঘটনাগুলো কীভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তাদের মতামতকে প্রভাবিত করেছে, তা যদি তারা বুঝতে পারেÑ তা হলে নিকট অতীত থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য তাদের ভাবনা সুসংহত হবে।