এক সময় উভকামী, সমকামী পুরুষ ও নারীদের জীবননাশ করা হতো সুইডেনে। যা এখন কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় না। সে সময় মনে করা হতো সমকামীতা একটি অসুখ। তাই সেটি সারিয়ে তোলার নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এখন একমত যে, একজন মানুষ কোন ধরনের যৌনতার প্রতি ঝুঁকবেন, তিনি একই লিঙ্গের কারোর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবেন নাকি বিপরীত লিঙ্গ বা উভয় লিঙ্গের প্রতি সেটি চাইলেই বদলে দেওয়া যায় না। এই ব্যাপারে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এখন মোটামুটি একমত যে যা অসুখ নয় তা সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৩ সালে সমকামীতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যুগের পরিবর্তনে মানুষের জ্ঞান বেড়েছে। যার ফলে এসব দেশে এসব এখন কোনো ঘটনা নয়। তারপরও একজন সাধারণ সেলার মাস্টারের প্রেমে পড়েছিল সুইডেনের বর্তমান রাজার দাদা রাজা গুস্তাফ পঞ্চম। তৎকালীন নিষিদ্ধ সম্পর্কের কথা নতুন করে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে নাটকীয়ভাবে। যা ভাবতে গা শিউরে উঠে যাবার কথা কিন্তু গণতন্ত্রের দেশে। এটাও প্রমাণিত যে বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে রাজ পরিবারও রেহাই পান না। তৎকালীন নিষিদ্ধ সম্পর্কের বিষয়ে জানতে কৌতূহল হবার কারণ তেমন কিছুই না, তবে সেই কেলেঙ্কারি গোপন রাখতে রাজ পরিবারের নিরাপত্তা বাহিনী কীভাবে দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করেছে সেটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। মূলত তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তুলে ধরা। ঘটনাটি তৎকালীন রাজাকে নিয়ে যা সুইডেনের সবচেয়ে বড় আইনি কেলেঙ্কারির একটি ঘটনা।
আরও পড়ুন: কে সেই সুন্দর
কুর্ট নামের এক রেস্টুরেন্টে ব্যবসায়ী যাকে এখানে সেলার নাস্টার বলা হয়। ঘটনাটা ১৯৩৩ সালের তখন কুর্টের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা করা হয় এবং কুর্টের ওয়াইন বিক্রির লাইসেন্স বাতিল করা হয়। নাইটক্লাব বা বারে যদি অ্যালকোহল বিক্রি না হয় তাহলে তো ব্যবসাই অচল। কুর্টের ফৌজদারি রেকর্ড মামলা মদ কেনা-বেঁচার লাইসেন্সের ওপর, মামলায় কুর্টের পরাজয় হয় এবং তার মদ কেনা-বেচার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে কোর্ট। কুর্ট পরে মামলা রাজা গুস্তাভ পঞ্চমের কাছে নিয়ে যায়। সেই সুবাদে পরিচয় এবং পছন্দ হয় কুর্টকে রাজার এবং একটি গোপন রোম্যান্স শুরু হয়। কিন্তু সমকামীতা এই সময়ে একটি অপরাধ, এবং রাজার স্ত্রী সন্তান রয়েছে, রয়েছে কুর্টেরও স্ত্রী তা সত্ত্বেও সমাজের উঁচু আর নিচু দুই পুরুষের রোমান্স। তারপর তাদের বয়সের বিশাল পার্থক্য।
প্রথমত রাজার গোয়েন্দা বাহিনী রাজাকে কুর্টের সঙ্গে দেখা না করার পরামর্শ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এদিকে কুর্টের স্ত্রীর আনা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আপিল করে। কারণ হিসেবে রাজার সঙ্গে কুর্টের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। যার ফলে রাজার আশেপাশের লোকেরা সম্পর্ক ঢাকতে সবকিছু করে। তারা কুর্টকে মানসিক চিকিৎসার জন্য মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করে। ঘটনাটি ঢাকতে এবং রাজাকে কেলেঙ্কারি থেকে রক্ষা করতে কত কিছুই না করা হয়। রাজা রাজ্যের সকল ক্ষমতার অধিকারী হবার পরও কুর্টের জন্য কিছুই করতে পারেননি।
আর পড়ুন: নতুন চমকের অপেক্ষায়
নিয়তির পরিহাস গরিবের প্রেমের জ্বালা শুধু গরিবই বুঝে। কখনো সমাজ ভাবেনি তারা যদি প্রেমে পড়ে থাকে, নিষেধ সত্ত্বেও একে অপরের সঙ্গে মিশতে বা একত্রে থাকতে কী ক্ষতি। সমাজ বলে কথা। তবে রাজা চেয়েছিলেন কুর্টের সঙ্গে বসবাস করতে। কিন্তু সমাজ সেটা মেনে নেয়নি। যাইহোক কুর্ট লেখালেখি থেকে শুরু করে নানাভাবে চেষ্টা করে রাজার থেকে কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ পেতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়ে উঠেনি। রাষ্ট্র মূলত বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই চেষ্টা করে। তারপর কত কিছু সেটা নিয়ে না বলি বরং রিফ্লেক্ট করি। আমার কাছে বিষয়টি একটি সর্বজনীন গল্প হয়ে উঠেছে।
সুইডিশ টেলিভিশন একটি বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেছে ছবিটি এবং তুলে ধরছে সেই ১৯৩৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সময়ের ঘটনাটি যা কালানুক্রমিকভাবে চলতে থাকবে। অনেক কিছুই ভালভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। তবে যা বলা হয়েছিল বন্ধ দরজার পিছনে, লিভিং রুমে এবং বিশেষ করে বেডরুমে, সেগুলো হয়তো চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি।
আমাদের সমাজে এসব ঘটনা আছে কি না বা থাকলেও তা যে খুব আকর্ষণীয় বলে কিছু হবে জানি না। তবে খুব কমই বয়স্ক ব্যক্তিদের যৌনতা এবং ভালবাসার কথা আমরা দেখতে পাই। গুস্তাফ পঞ্চম বয়স ৭০ এর বেশি এবং কুর্ট তেমন যুবক নয়, ৩৮ বছর বয়সী। এ বয়সে সংসার, মান, সম্মান, ভয়ভীতি, রাজপ্রাসাদ, ছেলে-মেয়ে, পরিবার সবকিছু ফেলে উভকামীতে যোগ দিতে সক্ষম হওয়া এবং এই সত্যটি সম্পর্কে বলতে পারা যে মহান প্রেম এবং আবেগ, জীবনের যে কোনো জায়গায় এবং যে কোনো সময় ঘটতে পারে, যা আমি গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ভেবেছি।
তাহলে কি এই ইভেন্ট সম্পর্কে আমি মুগ্ধ? না তবে এটা নিশ্চিত হয়েছি যারা উভকামী বা সমকামী এরা অসুস্থ না। এদের জন্ম হয়েছে এভাবেই। ঘটনাটি যদি রাজাকে কেন্দ্র করে না ঘটত জানিনে সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা এত সহজে হতো কি না। কিন্তু এর একটি অংশ হল যে আমরা এমন একটি সময়ের মধ্যে একটি অন্তর্দৃষ্টি পেয়েছি যেখানে দুই পুরুষের মধ্যে ভালবাসা যার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা গঠন করা যায় না। আজ যখন আমরা এই সম্পর্কের কথা পড়ি, তখন এটাকে একটি প্রেমের গল্প হিসাবেই ভাবি কিন্তু তখন এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।
সুইডেনের এই রাজা ‘গুস্তাফ ভি’ দীর্ঘদিন ধরে সমকামী গুজবে পরিবেষ্টিত ছিলেন এবং সবচেয়ে আলোচিত গল্পগুলোর মধ্যে একটি হলো ১৯৪৬ সালে একটি গাড়ি যাত্রার সময় তিনি কীভাবে তার ড্রাইভারের দিকে থাবা দিয়েছিলেন, যেটি তার একটি খাদে ড্রাইভ করার সঙ্গে শেষ হয়েছিল।
সবাই এই গুজবগুলি জানে বলে মনে হয়। অবশ্যই কেউ এটি সম্পর্কে লেখেনি। একজন বয়স্ক রাজার একটি উষ্ণ প্রতিকৃতি, দুর্গের এই একাকীত্ব জীবন, যে একজন টেনিস খেলায়াড় এবং সূচিকর্মকারী রাজা, যিনি একজন কূটনৈতিক লিজেন্ট ছিলেন এবং যিনি ৪৩ বছর দেশ শাসন করেছেন।
এটি এমন একটি সময়ে যখন অনেক রাজকীয় ঘর উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তিনি সেই সময়ের বিকাশ অনুসরণ করেছিলেন যখন সামাজিক গণতন্ত্র এবং শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের আভির্ভাব ঘটে। সমাজ এভাবেই ধাপে ধাপে ভালো মন্দের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে যা আমরা দেখেছি, তারপর এখনো যুদ্ধ ইউরোপে, এখনো গণতন্ত্রের অভাব বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে।
রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]