advertisement
advertisement
advertisement.

পোল্ট্রি খাত সিন্ডিকেটের খপ্পরে, লুটপাট চলছেই

রেজাউল রেজা
২৫ মার্চ ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৩ এএম
ফাইল ছবি
advertisement..

মুরগি ও ডিমের বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুরু হয় গত আগস্ট মাস থেকে। এর পর প্রায় ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও সেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেনি, বরং অস্থিরতা আরও বেড়েছে। এর জের টানতে হচ্ছে প্রান্তিক খামারিদের; উচ্চমূল্যের খড়্গ পড়ছে ভোক্তাদের ওপর। ছোট ছোট অনেক খামারি টানা লোকসানের মুখে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং স্বল্প আয়ের মানুষ ডিম ও মুরগি ছেঁটে ফেলেছেন খাবারের তালিকা থেকে। অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ খামারিদের আর ভোক্তাদের এমন দুর্দশায় ফেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটে নিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট।

দেশে প্রতিদিন মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয় ২০ লাখ, যা হাতেগোনা বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে। গত জানুয়ারির শুরুতেও প্রতি পিস বাচ্চার দাম ছিল ১০ টাকা। বর্তমানে তা ৬২ থেকে ৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে। উপরন্তু মুরগি ও ডিমের বাজারে যে অতিরিক্ত উচ্চমূল্য চলছে, সেই টাকার পুরোটাই চলে যাচ্ছে এই কারসাজিকারীদেরই পকেটে। বারবার বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ লুটে নিচ্ছে এই চক্র।

advertisement

গত আগস্ট মাসে প্রতিকেজি ব্রয়লারের দাম ২শ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর পর তা দফায় দফায় বেড়ে চলতি মাসে ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে কোথাও কোথাও ২৮০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। অথচ সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে তথ্য উঠে এসেছে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩৫ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত। এ মুরগি বাজারে ২০০ টাকার বেশি বিক্রি হওয়া অযৌক্তিক। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ভোক্তাকে বর্তমানে অন্তত ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে। এই অতিরিক্ত টাকার পুরোটাই চলে যাচ্ছে কারসাজিকারীদের পকেটে।

প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্র্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব বলছে, উৎপাদন ও পাইকারি বাজারে দামের ফারাক অনেক। দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন, যার বড় একটি অংশই সরবরাহ করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা। অর্থাৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কেজিপ্রতি অন্তত ৬০ টাকা বেশি মুনাফা করেছে।

বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন বাজারে ২ হাজার টন মুরগি আসে। সেই হিসাবে দিনে তাদের স্বাভাবিক মুনাফার বাইরেও আসে ১২ কোটি টাকা। এভাবে গত ৩১ জানুয়ারি থেকে

২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে ৬২৪ কোটি টাকা মুরগি বিক্রির মাধ্যমে অতিরিক্ত লাভ করেছে কোম্পানিগুলো। আর এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে তাদের মুনাফা ৩১২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর আগেও একইভাবে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

প্রান্তিক খামারিদের বক্তব্যে ঘুরেফিরে বারবার বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসছে আলোচনায়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অনুসন্ধানেও এমনটা দেখা গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতা কমিশনের মাধ্যমে মামলাও হয়েছে দোষীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু শাস্তি হয়নি। সরকারি সংস্থার হুশিয়ারি-মামলাতেও পোল্ট্রি খাতে বিশৃঙ্খলা কমেনি। যার ফলস্বরূপ গত সপ্তাহেও ব্রয়লারের দাম রেকর্ড ভেঙে প্রায় ৩শ টাকায় পৌঁছে যায়।

পোল্ট্রি খাতে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছলে ব্রয়লারের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যার জন্য গত বৃহস্পতিবার কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোল্ট্র্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড- এ চার প্রতিষ্ঠানকে তলব করে ভোক্তা অধিদপ্তর। ব্রয়লারের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে না কমলে আমদানির ব্যবস্থা করা হবে মর্মে হুশিয়ারও করা হয়। সেদিনই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই কার্র্যালয়ে মতবিনিময় সভা ডাকা হয়। কিন্তু সেখানে গরহাজির ছিলেন পোল্ট্রি খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।

এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, পোল্ট্রি শিল্প যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে, তাহলে তাদের সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে মাংস ও ডিম আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আমাদের দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমায় দীর্ঘসূত্রতা। দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা না হলে সেই শাস্তি কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। কারসাজিকারীরা পোল্ট্রি খাতে বারবার অতিরিক্ত মুনাফা করে নিচ্ছে। কিছুদিন আগেও দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের তৎপরতা থেমে নেই। অপরাধীকে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব না হলে আপরাধপ্রবণতা বাড়ে।

জানা গেছে, বিশৃঙ্খলার শুরু একদিনের বাচ্চার দাম নিয়ে। এমনিতেই বিশ্ববাজারের প্রভাবে পোল্ট্রি ফিডের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সেখানে মুরগির খাবার ও একদিনের বাচ্চার বাজার পুরোটাই বড় কোম্পানিগুলোর কব্জায় রয়েছে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় বাচ্চার দাম রাতারাতি বেড়েছে। অদৃশ্য মুঠোফোন বার্তায় হচ্ছে এমনটা। কেবল তাই নয়, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের নামে বড় কোম্পানিগুলো ছোট খামারগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে। এভাবে দল ভারী করছে সিন্ডিকেট চক্র। সেই সঙ্গে বাজারও তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। অপরদিকে বাচ্চার কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। বেশি দামেও বাচ্চা পাচ্ছেন না ছোট খামারিরা। বর্তমানে একদিনের বাচ্চার দাম ৬২ টাকা ছাড়ালেও ছোট খামারিরা এ দামে বাচ্চা পাচ্ছেন না। পেলেও তা অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের ছাতার নিচে যারা রয়েছেন তারা ঠিকই বাচ্চা পাচ্ছে। এতে ছোট খামারিরা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বড় প্রতিষ্ঠানের দাপটে এক পর্যায়ে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে তারা।

টানা লোকসানের মুখে দুই মাসেরও বেশি সময় হলো খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন জয়পুরহাটের খামারি মিজবাহ-উল-হক। তরুণ এই খামারি বলেন, পোল্ট্রি খাতে প্রতিটি ধাপে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে না থাকলে বাচ্চা পেতে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়, নইলে পাওয়া যায় না। অপরদিকে মুরগির বাজারদরও তাদের কব্জায়। টানা লোকসান দিয়ে কদিন ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায়? জয়পুরহাটের খামারগুলো থেকে দেশের মুরগির বাজারে উল্লেখযোগ্য জোগান দেওয়া হলেও বর্তমানে আমার মতো এ অঞ্চলের অনেক খামারি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, দেশে প্রতিদিন বাচ্চা উৎপাদন হয় ২০ লাখ, যা বড় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে থাকে। গত জানুয়ারির শুরুতে প্রতি পিস বাচ্চার দাম ১০ টাকা ছিল। বর্তমানে তা ৬২ থেকে ৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে তারা। এভাবে প্রতি পিস বাচ্চায় ৩০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত মুনাফা করছে কোম্পানিগুলো।

তিনি আরও বলেন, মুরগির বাচ্চা ও ফিডের মূল্য তথা উৎপাদনমূল্য বেঁধে না দিয়ে মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে সমস্যার সমাধান হবে না।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমাদের একার হাতে সবকিছু করার ক্ষমতা নেই। এ ক্ষেত্রে বেশকিছু সংস্থা সম্মিলিতভাবে কাজ করে থাকে। আমাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়। আমাদের দিক থেকে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অযৌক্তিক উচ্চমূল্যে মুরগি বিক্রি হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ডেকেছি। তারা মুরগির দাম কেজিতে ৩০-৪০ টাকা কমাবে বলে কথা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বাজারে এ দাম কমানোর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

গতকাল কারওয়ানবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির দাম সামান্য কমেছে। এতদিন ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল সকালে ব্রয়লারের দাম ২৫০ টাকায় নেমেছে। যদিও এ দামে কিনে খাওয়া এখনো অনেকের পক্ষে কষ্টকর।