দুই বছরের করোনা তাণ্ডবের পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। সার, জ্বালানি, খাদ্যসহ বহুমুখী সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আকাশচুম্বী নিত্যপণ্যের মূল্য। কোনো কোনো দেশের অর্থনীতির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি কৃষি খাতকে শক্তিশালী করে সামনে এগিয়ে যেতে। প্রধানমন্ত্রী বারবার তাগিদ দিচ্ছেন কোনো জমি অনাবাদি না রাখার। প্রধানমন্ত্রী শুধু আহ্বানেই ক্ষান্ত থাকেননি, নিজেই গণভবনের পতিতজমি ভরিয়ে তুলেছেন ফল-ফসলে। সেই অনুপ্রেরণায় অনেকেই যার যার জায়গা থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পতিতজমিতে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে অর্থনীতির বলয়কে সমৃদ্ধ করার। এমন একজন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ।
গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। এবারকার কৃষি বাজেট, কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানের একটি আয়োজন ছিল ওখানে। প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় আয়োজন, অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে ওনার উপস্থিত থাকার কথা। ফলে আগে থেকেই তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কৃষি আয়োজন দেখে তিনি বিশেষ অনুপ্রাণিত। মুক্তাগাছা শহরের পশ্চিমপ্রান্তে তার এক একর জমিতে তিনি সূর্যমুখী চাষ করছেন। তেলবীজ চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলাও তার অন্যতম প্রচেষ্টা।
অতীত ঐতিহ্যের চিহ্ন আছে মুক্তাগাছার এখানে-সেখানে, স্থাপনা ও পথে। আর সব শহরের মতো মুক্তাগাছাও পরিসরে বাড়ছে। মুক্তাগাছা-টাঙ্গাইল মূল সড়কের পাশে ব্যস্ত শহরের মাঝে এক টুকরো জমি যেন অন্য রকম। রঙিন ও সুন্দর। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য সূর্যমুখী। দীর্ঘদিন পতিত পড়ে থাকার পর এ জমিতে এখন গাছে গাছে আভা ছড়াচ্ছে মোহনীয় ফুলের রঙ। ব্যস্ত শহরের মাঝে কৃষির এমন সৌন্দর্যে মুগ্ধ নগরবাসী। এটি এখন শহরের মানুষের জন্য পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সূর্যমুখীর সৌন্দর্য দেখতে শহর তো বটেই, গ্রাম থেকেও মানুষ ভিড় করছে এখানে।
সম্ভাবনাময় সূর্যমুখীর চাষ নিয়ে এর আগেও হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করেছি। বছর পাঁচেক আগে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গ্লোব গ্রুপের বিশাল সূর্যমুখী বাগানের চিত্র তুলে ধরেছিলাম। সারাদেশেই সূর্যমুখীর চাষ বাড়ছে। তেলবীজ হিসেবে এর গুরুত্বও অনুধাবন করতে পারছে মানুষ।
দেশের ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ আমদানি থেকে এবং ১২ শতাংশ দেশীয় জোগান থেকে পূরণ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি করতে হয়েছে। বর্তমানে দেশে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখীদানা থেকে প্রায় ৩ লাখ টন তেল উৎপাদন হয়। অর্থাৎ ধরতে গেলে ভোজ্যতেলের পুরোটাই আমাদের আমদানিনির্ভর। তাই এখন থেকেই প্রস্তুত নিতে হবে নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধির।
সংসদ সদস্য কেএম খালিদের সূর্যমুখীর বাগানটা শুধু সূর্যমুখীর নয়, বাগানের চারপাশে নানা সবজির চাষ। ভুট্টা থেকে শুরু করে লালশাক, পালংশাক, ফুলকপি, শালগম, বাঁধাকপিসহ মৌসুমি বিভিন্ন সবজির চাষ হচ্ছে। বাগান ঘুরে দেখতে দেখতেই এগিয়ে এলেন কেএম খালিদ। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম সূর্যমুখীর মাঠে। শুধু এই এক একর পতিতজমিতে কৃষির আবাদ নয়, নীতিগতভাবে কেএম খালিদ কৃষিকে এগিয়ে রাখতে চান সব সময়। বিশেষ করে ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি তাকে প্রভাবিত করেছে নিরাপদ তেলবীজ উৎপাদনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে। সাংস্কৃতিকবলয়ে বেড়ে ওঠা কেএম খালিদের আশৈশব কৃষির প্রতি টান। মুক্তাগাছার মনতলা গ্রামে তার গৃহস্থবাড়িÑ যেখানে কৃষির নানা আয়োজন, সেখানেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। পুকুরে মাছ। পুকুরপাড়ে ফলের গাছ। আম, লিচু, ড্রাগনসহ আছে নানা সবজিরও চাষ।
কেএম খালিদ জানাচ্ছিলেন, কৃষিকে মাথায় রেখে তিনি নিতে চান আগামীর পরিকল্পনা। নতুন এক মডেল দাঁড় করাতে চান তার উপজেলায়। প্রধানমন্ত্রীর এক ইঞ্চি জমি পতিত না রাখার যে আহ্বান, তা তিনি ছড়িয়ে দিতে চান সবার মধ্যে। ফল-ফসলে ভরিয়ে তুলতে চান সবখানে। শুধু ফসল কৃষিই নয়, প্রাণিসম্পদ উৎপাদনেও রয়েছে তার বিশেষ পরিকল্পনা। সূর্যমুখী বাগানটি তত্ত্বাবধায়ন করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। মাঠে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন। তার সঙ্গেও কথা বলি। মুক্তাগাছা ফসল বৈচিত্র্যে দারুণ এগিয়ে। উচ্চমূল্যের ফল-ফসল চাষে মানুষ বেশ অনুপ্রাণিত। তরুণরাও এগিয়ে আসছে। সংসদ সদস্যের বিশেষ আগ্রহে যান্ত্রিক কৃষির প্রসারে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। যান্ত্রিক কৃষির প্রসার থেকে শুরু করে সার্বিক কৃষির একটি মডেল তৈরি করতে চান প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। তিনি মনে করেন, কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমেই আমাদের জাতীয় উন্নয়ন টেকসই হবে।
শুধু শহরের মানুষই নয়, কৃষকরাও এখানে এসে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তেলবীজ উৎপাদনে। কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন বলছিলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সরিষা আবাদের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ বেশি। সূর্যমুখীর চাষ বৃদ্ধি করতে পারলে তেলবীজ উৎপাদন আরও বাড়বে। বিশেষ করে ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে এ উদ্যোগগুলো ভূমিকা রাখবে।
নতুন ফল-ফসল চাষে কৃষককে তথ্য ও প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করতে হয় বেশি। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ কতটা প্রস্তুত জানতে চাই। সেলিনা পারভীন জানান, কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতিই আছে। তবে একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার আওতায় থাকেন গড়ে এক হাজার থেকে বারোশ কৃষক। কৃষি তথ্য বা সেবাদানের জন্য সংখ্যাটি যথেষ্ট বেশি।
বাগানে উপস্থিত কয়েক কৃষকের সঙ্গেও কথা বলি। তারা জানান, সূর্যমুখীর সৌন্দর্য তাদের মোহিত করেছে। ফলনও ভালো। তাদেরও ইচ্ছা আছে আগামীবার সূর্যমুখী চাষের।
যে কোনো ফসল চাষের বিস্তার বৃদ্ধির আগে বুঝে নিতে হবে বাজারব্যবস্থা। কৃষি বিভাগকেই বুঝতে হবে কৃষক উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারবে কিনা। উৎপাদন খরচ আর বাজার বুঝে কৃষককে পরামর্শ দিতে হবে। আমাদের দেশে খাদ্য হিসেবে সূর্যমুখী বীজের ব্যবহার খুব বেশি নয়। তেল উৎপাদনে সূর্যমুখী বীজের বাজার চাহিদা যাচাই করার দরকার আছে। এ বিষয়ের কৃষি বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন সুপরিকল্পনা।
সংকট উত্তরণে কৃষির প্রতি যে তাগিদ এসেছে, তা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় পরিপূর্ণতা পাক, কৃষি ঘিরে তৈরি হোক সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক বলয়। এ ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন থেকে বাজার ব্যবস্থাপনাÑ সবখানেই প্রয়োজন সুপরিকল্পিত সমন্বয়। আর এ প্রেক্ষাপটে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তি উদ্যোগগুলো আশাজাগানিয়া। আমাদের বিশ্বাস, সবার অংশগ্রহণ ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনার সুষম বিকাশে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ হবে কৃষি সমৃদ্ধির উন্নত বাংলাদেশ।
শাইখ সিরাজ : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব