advertisement
advertisement
advertisement.

যতই দিন যাচ্ছে, বাড়ছে মানবপাচার

আর কে চৌধুরী
২৮ মার্চ ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৩ ১১:০০ পিএম
advertisement..

মাদক ব্যবসা ও অস্ত্রপাচারের পর মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানবপাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলোর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল কার্যক্রম হচ্ছে মানবপাচার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এই অপকর্মের জন্য ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত।

একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় কিংবা একটু উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমান। কিন্তু বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ হয় খুব কম মানুষের। আর এই সুযোগটাই নেয় দালাল বা প্রতারক শ্রেণি। ভালো চাকরি, লোভনীয় সুযোগ-সুবিধার কথা বলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আকৃষ্ট করে। তার পর টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দেয় ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে। জীবনও দিতে হয় অনেককে।

advertisement

এর আগেও ভূমধ্যসাগরে বহু ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। বহু বাংলাদেশির সলিলসমাধি হয়েছে। অনেকে সাগরে ভাসতে ভাসতে পানীয়জল ও খাবারের অভাবে মারা গেছেন। শুধু তা-ই নয়, অনেককে লিবিয়ার মরুভূমিতে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ভিডিও পরিবারকে দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এমন ঘটনা ঘটে অন্যান্য গন্তব্যেও। নৌকায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে অনেকেরই সলিলসমাধি হয়েছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাংলাদেশিদের বহু গণকবরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। তার পরও এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো বন্ধ হয়নি। আর এর প্রধান কারণ, দেশজুড়ে মানবপাচারকারীদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। তাদের অন্যতম টার্গেট তরুণ বা যুবক শ্রেণি।

যতই দিন যাচ্ছে, বাড়ছে মানবপাচার। মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনওডিসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত প্রথম জাতীয় মানবপাচারবিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, মানবপাচারের শিকার মানুষের বেশিরভাগই অত্যন্ত গরিব এবং জীবিকার তাগিদে এ পথে পা দেন। বিশেষ করে পাচারকারীরা রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা; বান্দরবান, কিশোরগঞ্জ, মাগুরা ও জামালপুর জেলার বাসিন্দাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে বিদেশে পাচার করে থাকেন।

বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের কারণ ও ঝুঁকি চিহ্নিত করার পাশাপাশি ওই প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে অপরাধ দমনে শক্তিশালী প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা, ভুক্তভোগীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা, মানবপাচার ও জোর করে শ্রম বন্ধ করতে কৌশলপত্র প্রণয়ন।

পাচার রোধে বক্তৃতা-বিবৃতি, গবেষণাই যথেষ্ট নয়। সরকারকে দ্বিমুখী কার্যক্রম জারি রাখতে হবে। এক. যাতে পাচার না হতে পারে সেজন্য সীমান্তে কঠোর পাহারা, দুই. পাচারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে মানবপাচারবিরোধী কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই।

মানবপাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ প্রতিরোধের দায়িত্ব মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। বিমান, নৌপথ কিংবা সড়কপথে যাতে কেউ পাচার করতে না পারে, সেজন্য সীমান্তরক্ষীদের সদাসতর্ক থাকতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে মানবপাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতাও। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানবপাচারের ঘটনায় আসামি ধরা পড়লেও বিচার হয় না। শাস্তি পায় না। আমরা যদি পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারি, মানবপাচার চলতেই থাকবে।

সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার বেড়েই চলেছে। প্রকৃতই পাচারের সংখ্যা বেড়েছে, না কর্তৃপক্ষ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করায় আগের চেয়ে বেশি দক্ষ হয়েছে, তা বিচার করা কঠিন। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, প্রতিবছর হাজারো মানুষ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছেন। এর পেছনে মূলত দায়ী ভালো চাকরির আশায় মানুষের বিদেশে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু তারা পাচার হচ্ছেন কিনা বা জোরপূর্বক তাদের ক্রীতদাসের মতো কোনো কাজে আটকে রাখা হচ্ছে কিনা, এসবের ঝুঁকি সম্পর্কে ভালো করে না জেনেই তারা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ভালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে এবং পাচারের শিকার অনেককে উদ্ধারও করতে পেরেছে। একটি মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সাফল্যের কারণে মানবপাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে দুই ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। মানবপাচারের কিছু মূল হোতাকে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জানা গেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অথবা তারা নিজেরাই ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ। এ থেকে আরও বোঝা যায়, কীভাবে সমাজের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান মানুষরা তাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দাসত্বের এই আধুনিক রূপটিকে চালু রেখেছেন। নিঃসন্দেহে, এতে মানবপাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরও জটিল হয়ে গেছে। তার পরও কর্তৃপক্ষের উচিত এই অপরাধ দমনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম