আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে শেষ করতে কোনো রাজনৈতিক দলই দৃশ্যত জাতিসংঘের কাছে সহায়তা চায়নি। তবে জাতিসংঘ ‘স্বপ্রণোদিত’ হয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চেয়েছে। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার চাইলে আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে।
গতকাল সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এ প্রস্তাব দেন গোয়েন লুইস। তবে জাতিসংঘের এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। গোয়েন লুইসকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনে জাতিসংঘের সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশিদের স্বাগত জানানো হবে বলেও লুইসকে জানান তিনি।
এখন প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচনে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে? জাতিসংঘ কোনো দেশের নির্বাচনে পরামর্শ, কারিগরি, লজিস্টিক, প্রশিক্ষণ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রভৃতি সহায়তা করে থাকে। সংস্থাটি ইতোমধ্যে শতাধিক রাষ্ট্রকে নির্বাচনী সহায়তা দিয়েছে। এ কাজগুলো জাতিসংঘ সরাসরি করা ছাড়াও এর অঙ্গ ও বিশেষায়িত সংস্থাগুলোও করে থাকে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) নির্বাচনে কারিগরি সহায়তা প্রদান, অবকাঠামো নির্মাণ ও জাতিসংঘের হয়ে নির্বাচনী সহায়তাদান সমন্বয় করে থাকে। আর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, নির্বাচনী আইন তৈরি ও পদ্ধতি নির্ধারণ এবং নির্বাচনকালীন মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে।
জাতিসংঘ অনেক সময় নির্বাচন পর্ববেক্ষকের ভূমিকাও পালন করে। এ ছাড়া নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ের কাজও করে থাকে সংস্থাটি। সাধারণত বিদেশি পর্যবেক্ষকরা তাদের দেশের বা প্রতিষ্ঠানের হয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে।
দেশে দেশে নির্বাচনে সহায়তা
আমাদের কাছের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের তিনটি নির্বাচনে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ। ২০০৪ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে হামিদ কারজাই আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরের বছর ২০০৫ সালে আফগান পার্লামেন্টের ওলেসি জিগরা বা নিম্ন কক্ষের নির্বাচনে সহায়তা করে জাতিসংঘ। তখন একইসঙ্গে ৩৪টি প্রাদেশিক পরিষদেরও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সবশেষ ২০১০ সালেও ওলেসি জিগরার নির্বাচনে সংস্থাটি সহায়তা করে। বলে রাখা যেতে পরে, জাতিসংঘ যখন আফগানিস্তানে এ তিন নির্বাচনে সহায়তা করে, তখন দেশটিতে মার্কিন ও তাদের পশ্চিম মিত্রদের সৈন্য মোতায়েন ছিল।
ইরাকে মার্কিন ও তাদের মিত্রদের আগ্রাসনের ফলে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এরপর ২০০৪ সালের ২৮ জুন ইরাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে আসে। তাদের অধীনে ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে সহায়তা করে জাতিসংঘ। এ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল উদ্বাস্তু অথবা দেশের বাইরে যেসব ইরাকি অবস্থান নিয়েছেন, তাদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধন ও ভোটদানের ব্যবস্থা করা। জাতিসংঘের হয়ে এ কাজটি করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। এরপর ২০১০ সালেও ইরাকের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সহায়তা করে জাতিসংঘ।
১৯৯০ সালে নিকারাগুয়া, ১৯৯২ সালে অ্যাঙ্গোলা, ১৯৯৩ সালে কম্বোডিয়ার নির্বাচনে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ। পরের বছর ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও এল সালভাদরের নির্বাচনে সহায়তা করেছে সংস্থাটি। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ সহায়তা করেছে মোজাম্বিকের নির্বাচনে। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন পূর্ব স্লাভোনিয়ার (বর্তমানে ক্রোয়েশিয়া) নির্বাচনে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ। পরের দুই বছর দুটি নির্বাচনে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের নির্বাচনে সহায়তা করেছে সংস্থাটি।
২০০৬ সালে হাইতি ও ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোঁর নির্বাচনে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ। হাইতিকে ২০১০ সালের নির্বাচনেও সহায়তা দিয়েছে তারা। এ বছর কোটে দ্য লাভোয়ার নির্বাচনে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ। পরের বছর ২০১১ সালের নির্বাচনেও সহায়তা করেছে সংস্থাটি।
গণভোটে সহায়তা
জাতীয় নির্বাচনের বাইরে গণভোটেও বিভিন্ন দেশকে সহায়তা করে থাকে জাতিসংঘ। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার প্রশ্নে নামিবিয়ায় যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে নির্বাচন তদারকি ও বাস্তবায়নের ভূমিকা পালন করে জাতিসংঘ। এরপর নামিবীয়রা ১৯৯০ সালের ২১ মার্চ স্বাধীনতা লাভ করে। এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখে জাতিসংঘ।
২০০১ ও ২০০২ সালে তৎকালীন পূর্ব তিমুরের নির্বাচনে সহায়তা করে জাতিসংঘ। এ নির্বাচনের পর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে এবং তিমুর-লেস্তে নামে নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতা লাভের পর ২০০৭ ও ২০১২ সালে তিমুর-লেস্তের নির্বাচনেও সহায়তা করে জাতিসংঘ।
২০১০ সালে সুদানের নির্বাচনে সহায়তা করে জাতিসংঘ। পরের বছর দক্ষিণ সুদানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ এ ভোটে আইনি ও কারিগরি সহায়তা দেয়। এ ভোটের ফলের ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভ করে দক্ষিণ সুদান।
পর্যবেক্ষক হিসেবেও গণভোটে অংশ নেওয়ার নজির আছে জাতিসংঘের। ১৯৯৩ সালে ইরিত্রিয়ার গণভোটে পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় ছিল সংস্থাটি।
ফকির জহুরুল: সহসম্পাদক, আমাদের সময়