advertisement
advertisement
advertisement.

বাইকাররা যেন এ যুগের ‘নন্দ ঘোষ’

নিহার তরফদার
৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:৪১ পিএম | আপডেট: ৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৪০ পিএম
উন্নত দেশগুলোতে নিয়ম মেনে বাইক মহাসড়কে চলাচল করে। প্রতীকী ছবি
advertisement..

প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। যে-যত দোষ করুক না কেন, সব নন্দ ঘোষের ঘাড়েই যায়! বর্তমানে সেই নন্দ ঘোষ হচ্ছে ‘বাইকার’। সড়কে বা মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটলে সেই দায় যেন শুধু তাদেরই। ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে অন্য চালক বা যানবাহন জড়িত, তারা যেন ‘ধোয়া তুলসি পাতা’। আসলে ওই দুর্ঘটনার জন্য কে বেশি দায়ী, তা বিবেচনা না করেই সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় দুর্বল সেই নন্দের ওপর। আর তার ভাগিদার হতে হয় সব বাইকারদের।

সত্যিই সব ক্ষেত্রে যদি দুর্ঘটনার জন্য বাইকাররাই দায়ী হন, তাহলে কঠোর নিয়ম-কানুন করার পাশাপাশি তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করলেই তো হয়। কিন্তু এসব কিছু না করে বারবার দোষ চাপিয়ে নতুন নতুন আইন তৈরি ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আসলে কতটা যৌক্তিক? মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এড়াতে খুব শিগগিরই ‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩’ তৈরি করছে সরকার।

advertisement

নতুন আইনে যা আছে

*সড়কভেদে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গতি নির্ধারণ করবে

*স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষও গতি নির্ধারণ করতে পারে

*মহাসড়কে সর্বোচ্চ নির্ধারিত গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার

*রাজধানীর ক্ষেত্রে সড়কভেদে তা ৩০-৬০ কিলোমিটার

*যেকোনো শহরের ভেতরে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার

*মহাসড়কে ১২৬ সিসির কম ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল চলবে না

*আরোহী নিয়ে চলাচল করা যাবে না

*ঈদ ও উৎসবের সময় মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে না মোটরসাইকেল

*মোটরসাইকেলে বয়স্ক ও শিশু পিলিয়ন পরিবহন করা যাবে না

এই আইনের অনুমোদন এখনো হয়নি। তবে আইনটি পাস হলে আদৌ কি মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব? ধরে নিলাম, একটি বাসের গতি ৪০ কিলোমিটার আর একটি প্রাইভেটকারের গতি ৫০ কিলোমিটার। তখন তার সামনে যদি ৩০ কিলোমিটার গতিতে একটি মোটরসাইকেল চলে, তাহলে সেখানকার পরিস্থিতি কী হবে? হয়তো রাস্তায় যানজট তৈরি হবে না হলে ওই মোটরসাইকেলচালক বাস অথবা প্রাইভেটকারের চাকায় পিষ্ট হবেন। অঙ্কের হিসাবে সেটাই বলে।

বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া দরকার

একটি দেশের নীতিমালা হওয়া দরকার সেই দেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। একটি শহরের নীতিমালা হওয়া দরকার সেই শহরের মানুষের কল্যাণে। যদি কোনো দেশে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের জন্য বা দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য ৩০ কিলোমিটার গতির কোনো নিয়ম থেকে থাকে, তাহলে সেই সমস্ত দেশে বা শহরে আরও অনেক কিছুই আছে। মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভরশীল মানুষ সেই সমস্ত দেশে হয়তো খুব বেশি নন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওই সব দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বেশি। সেখানে বাস, ট্যাক্সি, মেট্রোরেল, পাতাল রেলসহ নানা রকমের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের ঢাকা শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে তেমন কী কিছু আছে?

আমাদের শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মধ্যে রয়েছে রংচটা লক্কড়-ঝক্কড় ফিটনেসবিহীন বাস। এর মধ্যে অনেক বাসচালকের ড্রাইভিং লাইন্সেস নেই। কোন লেন দিয়ে চলবে, কোথায় দাঁড়াবে, কত গতিতে চলবে—সেসবের কোনো তোয়াক্কা নেই।

আরেকটি জনপ্রিয় গণপরিবহন হচ্ছে লেগুনা। অবৈধ একটি পরিবহন এটি। ফিটনেসবিহীন এসব লেগুনা বেপরোয়া গতিতে ৮-১০ বছরের শিশু-কিশোরেরা দেদারচ্ছে চালাচ্ছে শহরের প্রধান সড়কগুলো দিয়ে।

আরেকটি ইঞ্জিনবিহীন পরিবহন হচ্ছে রিকশা। রিকশা সাধারণত প্রধান সড়কে চলার জন্য নয়। তারপরও অবাধে রাস্তার মধ্যে জটলা পাকিয়ে তৈরি করছে যানজট, কখনো রিকশা চালকদের ভুলের কারণে ঘটছে বড় দুর্ঘটনা। সব মিলিয়ে নগরে তৈরি হয়েছে জঞ্জাল। কিন্তু এগুলো নিয়ে নীতিনির্ধারকদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। এসব জঞ্জাল ঠিক না করে তাদের জন্য কোনো নিয়ম তৈরি না করে শুধুমাত্র মোটরসাইকেলকে নিয়ে যদি নীতিমালা তৈরি হয়, তাহলে সেটা কতটা যৌক্তিক?

সহায়তা না করে বন্ধের পাঁয়তারা

বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। কিন্তু মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ে এমন পরিস্থিতির কারণে মনে হয় আমরা এখনো নিন্ম আয়ের দেশ। পৃথিবীর অনেক দেশেই মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলছে। হ্যাঁ এটা ঠিক মোটরসাইকেল অনিরাপদ একটি যানবাহন। তারপরও ওই দেশগুলো মোটরসাইকেলকে বিভিন্ন উপায়ে, বিভিন্ন কৌশলে এবং নিয়মতান্ত্রকিভাবে মহাসড়কে চলাচল করার জন্য সহযোগিতা করছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আমাদের দেশে সেই সাপোর্ট না দিয়ে উল্টো বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।

একটি দেশ চলবে তার আইনের ওপর। কেউ যদি ট্রাফিক আইন না মানেন, তাহলে তার নামে শাস্তি হবে। সেটা না করে যদি সবাইকেই সেই শাস্তির আওতায় ফেলা হয়, তাহলে সেটা কতটা যৌক্তিক? কিছু উচ্ছৃঙ্খল বাইকাদের জন্য যারা নিয়ম মেনে বাইক রাইড করেন, তাদের কেন শাস্তির আওতায় ফেলা হবে?

আমরা যেহেতু এগিয়ে যাচ্ছি, আমার দেশের সিস্টেমগুলোকেও এগিয়ে নিতে হবে। মহাসড়কে চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ যেমন নি গার্ড, রেট্র-রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি সড়কে যেন কোনো প্রকার গর্ত, পিচ্ছিল উপকরণ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা, ভাঙাচোরা ইত্যাদি না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত সাইন ও মার্ক থাকতে হবে।

সব দোষ নন্দ ঘোষের ঘাড়ে চাপিয়ে কোনো সমাধান হতে পারে না। আশা করি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। সরকার, গণমাধ্যম, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণ একযোগে কাজ করলেই কেবল দেশে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

নিহার তরফদার: সহসম্পাদক, আমাদের সময়