বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। নতুন বছরে সকল অপশক্তির বিনাশের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐকতার প্রত্যয় নিয়ে আয়োজন করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিভিন্ন রঙের ফুল, পশু-পাখি, রূপকথার চরিত্রের রঙ-বেরঙের শিল্পকর্মে সজ্জিত হয়ে বৈশাখের প্রথম দিনে বের হয় এ মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন থিম নিয়ে আয়োজিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাঘ, হাতি, কুমির ইত্যাদি থিম মঙ্গল শোভাযাত্রায় দেখা যাওয়ার পাশাপাশি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানানো হয় এ শোভাযাত্রা থেকে।
প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন হয়েছিল যশোরে। যশোরের ‘চারুপীঠ’ নামক সংগঠনের কর্মীরা সানাইয়ের সুর ও বাদ্যের তালে পেখম মেলা ময়ূর, প্রজাপতি, বাঘ, দৈত্য-দানো সেজে কিংবা বিভিন্ন আকারের মুখোশ পরিহিত অবস্থায় পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। সময়টা ছিল ১৯৮৫ (বাংলা ১৩৯২ সন)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রথম বর্ষবরণ শোভাযাত্রাটি বের হয় ১৯৮৯ সালে। পরবর্তীতে ১৯৯১ সাল হতে বর্ষবরণ শোভাযাত্রাটি পরিচিতি পায় মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে। মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যাপ্তি এখন দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
ইউনেস্কো বলছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভের বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই ও ন্যায়, সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণকে বিবেচনায় নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইউনেস্কো কমিটি এই স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি উদযাপনের জন্যে যেসব কলা ও শিল্পের প্রদর্শন হয় সেটার জ্ঞান এসব ছাত্র ও শিক্ষক সমাজে ছড়িয়ে যায়।
গ্রাম এবং শহরে পয়লা বৈশাখ উদযাপনে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। নগরজীবনে সাধারণত সব শ্রেণিপেশার এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। বৈশাখের প্রভাতে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, কপালে টিপ, খোপায় ফুল, হাতে বাহারি রঙের চুড়িতে নারীদের এবং ছেলেদের পাজামা ও পাঞ্জাবি পরিধান করতে দেখা যায়। শহরের কিছু জায়গায় পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন করা হলেও গ্রামীণ লোকজ মেলার দেখা মেলে গ্রামে-গঞ্জে। মেলায় দৃষ্টিনন্দন স্টলগুলো তৈরি করা হয় পরিবেশবান্ধব বাঁশ, কাঠ, ছনসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে। এখানে মেলা উপলক্ষে বসে নাগরদোলা, যাত্রা, চরকি, বায়োস্কোপ ও গানের আসর। মেলায় দোকানিরা পসরা সাজাই বাঁশ-বেতের ঝুড়ি-মোড়া, হাওয়াই-মিঠাই, মুরলি, নিমকি, বাতাসা, নলখাগড়ার বাঁশি ও হরেক রকম মিষ্টির। গ্রামে সে সঙ্গে যুক্ত হয় নৌকাবাইচ ও বলি খেলা।
বর্তমানে গ্রামীণ এসব লোকজ মেলা থেকে অনেক আদি উপাদান বিলুপ্তির পথে, হারিয়ে যেতে বসেছে নিকট অতীতে বিভিন্ন লোকজ পেশার সঙ্গে জড়িতরা। এখন আর চোখে পড়ে না অতি মনযোগের সঙ্গে মেলার স্টলে বসে কোনো মৃৎশিল্পীর মাঠির পাত্রে নকশা কাটার দৃশ্য বা হাতপাখায় নকশা উঠানোর দৃশ্য কিংবা শীতল পাটি বোনার সুন্দর দৃশ্য। আগে মেলার পাশাপাশি যে কবিগান, পালাগান, জারিসারি, বাউল গান, ভাটিয়ালি গান, মাইজভাণ্ডারী গান, বিরিশিরি, ছড়া পাঠের আসর, পুঁথি পাঠ, লাঠি খেলার আসর বসতো এখন তার আর কিছুই দেখা যায় না। মেলা আয়োজনের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আমাদের সংস্কৃতির এসব আদি উপাদানকে উৎসাহিত করা হয়।
পার্বত্য অঞ্চলে পয়লা বৈশাখকে বৈসাবি নামে ডাকা হয়। মূলত ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী কয়েকটি গোষ্ঠীর উদযাপিত উৎসবের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বৈসাবির নামকরণ করা হয়েছে। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু, এ তিন গোষ্ঠী পয়লা বৈশাখ পালনের জন্য যে অনুষ্ঠান আয়োজন করে তার প্রথম অক্ষর নিয়ে হয় বৈসাবি। বৈসু ও বিজু পালিত হয় চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। বিভিন্ন মন্দিরে, নদীর তীরে, বাসস্থানে কিংবা বিশেষ পবিত্র স্থানগুলোতে ফুল, ধুপ, দীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় বিভিন্ন প্রকার সবজি সহকারে বিশেষ খাদ্য পাঁচন রান্না করা হয়।
বিশ্বাস করা হয় যে, এ পাঁচনের দৈব গুণাবলী নতুন বছরের সকল অসুস্থতা ও অমঙ্গল দূর করে। বৈসাবি উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ জলখেলা। জলখেলায় তারা পরস্পরের দিকে পানি ছিটিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সকল অপ্রাপ্তি, দুঃখ ও অপূর্ণতা ধুয়ে যায়।
সংস্কৃতিকে লালন করা, উপলব্ধি করা এবং প্রতিনিয়ত সংস্কৃতির চর্চা করা যে কোনো জাতির জন্যই গৌরবের। বাংলা নববর্ষ বাঙ্গালির সকল সত্তা, অস্তিত্ব ও অনুভবের সঙ্গে মিশে আছে। পয়লা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা যা ভাবি, পছন্দ করি এবং যা প্রতিদিনের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয় তাই আমাদের সংস্কৃতি। আপনি যখন একে অন্য কিছুর সঙ্গে গুলিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে খেয়ে ফেলেন তখন আমার গাধা আর শেয়ালের গল্পটা মনে পড়ে যায়।
একদা এক বনে এক গাধা আর শেয়াল গল্প করছিল, হঠাৎ গাধা শেয়ালকে দূরের মাঠ দেখিয়ে বলল, ‘দেখ শেয়াল ঘাসগুলো কি সুন্দর গাঢ় হলুদ।’
শেয়াল বলল- হলুদ কোথায়? ঘাস কি হলুদ হয়? ওটা সবুজ। গাধা বলল, না ঘাস হলুদ। শেয়াল বলে, না সবুজ। প্রচুর ঝগড়া করে হাঁপিয়ে শেষে তারা বনের রাজা সিংহের কাছে বিচার চাইতে গেল। পুরো ঘটনা শুনে সিংহ শেয়ালকে দোষী ঘোষণা করে খাঁচার মধ্যে বন্দি করার আদেশ দিলেন। শেয়াল কাঁদতে কাঁদতে বলল, একি বিচার সিংহ মশাই? ঘাসতো সবুজই হয়, তা জেনেও আপনি আমাকে শাস্তি দিলেন। আমার কি অপরাধ। সিংহ বলল, তোর সবচেয়ে বড় অপরাধ তুই গাধার সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছিস। আর তাই তুই খাঁচায় বন্দি থাকবি।
কিছু জিনিস যেমন আছে তেমনই সুন্দর। বৈচিত্রতা সুন্দর ও শাশ্বত। সংস্কৃতিকে সংকুচিত করে নয় বরং এর ব্যাপ্তি যত বেশি হবে ততই সৌন্দর্য আলো হয়ে সমাজে ছড়াবে। নতুন বছরে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠুক এ প্রত্যাশা।
শিবু দাশ সুমিত: সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল