advertisement
advertisement
advertisement.

ভারসাম্য বজায় রেখে আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন সুযোগ

বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাপত্র

আব্দুল্লাহ সাদী
২৬ মে ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩ ১১:৫২ পিএম
advertisement..

বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ দফা ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ এই ধারণাপত্র ঘোষণার জন্য কাজ করে আসছিল। দীর্ঘদিনের নানা জল্পনা-কল্পনা শেষে অবাধ, মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, সুরক্ষিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক গঠনের এই রূপরেখা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক জিডিপিতে এই অঞ্চলের যৌথ অংশীদারিত্ব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রাধান্য, বর্ধিষ্ণু জলবায়ু কর্মসূচি ও ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বাংলাদেশের নিজস্ব ধারণাপত্র ঘোষণায় ভূমিকা রেখেছে। এর আগে এ অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইইউ, আসিয়ান এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরও) তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণা করেছে। তবে বাংলাদেশ এ অঞ্চলকে ঘিরে তাদের রূপরেখাকে কৌশল হিসেবে সম্বোধন না করে ধারণাপত্র বা আউটলুক হিসেবে অভিহিত করেছে।

বাংলাদেশের ঘোষণাটি যখন এসেছে তখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বড় ধরনের পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার অর্থনৈতিক আধিপত্য ও তীব্র কৌশলগত প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, সমুদ্র অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা, বিশাল বাজার ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে বৃহৎ শক্তিগুলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন কৌশল তৈরি করেছে।

advertisement

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে সব দেশের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। ইতোমধ্যে তথাকথিত পরাশক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে এই অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের এক নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপ, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামসহ এই অঞ্চলকে ঘিরে বিভিন্ন উদ্যোগ সামনে আসার ফলে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ সুরক্ষায় নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত ভূ-রাজনীতি অঞ্চলটিকে আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ঠেলে দিয়েছে।

একদিকে ইন্দো-প্যাসিফিককে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন চরম মাত্রায়, তখন অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে শক্তিশালী অবস্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশ বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তা ছাড়া এক দশক আগে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিশাল সামুদ্রিক এলাকায় বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের একটি প্রধান সামুদ্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশসহ অনেক উপকূলীয় দেশের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিকের ওপর নির্ভর করছে। বর্তমানে আইওআরএ-এর সভাপতিত্ব করছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে ৬ষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে অবহেলিত উল্লেখ করে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন। আইপিও ছাড়াও এর আগে বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে, যা ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়েছে।

সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব- কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, টেকসই উন্নয়ন নীতিমালা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবিক পদক্ষেপ, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য গঠনমূলক আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাÑ এই ৪টি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে মূলত বাংলাদেশের ১৫ দফা ধারণাপত্রটি তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক-কৌশলগত পরিবেশ বিবেচনায় বেশকিছু কারণে বাংলাদেশের গৃহীত ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখাকে ‘গেম চেঞ্জিং’ ধারণা হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়।

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলসীমান্ত দ্বারা সংযুক্ত বাংলাদেশের তৃতীয় প্রতিবেশী বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি হলেও, ভারত মহাসাগরকে এর চতুর্থ সীমান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার ফলে এই অঞ্চলের মধ্যকার গভীর সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের জন্য অত্যাবশ্যক। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এই অঞ্চলের একটি বড় স্টেকহোল্ডার হিসেবে বৈশ্বিকভাবে পরিচিতি পেয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ধারণাপত্রটি ঘোষণার সময়কাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের তিন প্রভাবশালী নেতৃত্ব জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রাক্কালে এটি ঘোষণা করা হয়েছে, এর থেকে যথাযথ সময় আর হতে পারে না। বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে, যাতে এ অঞ্চলকে ঘিরে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ না থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সাংবিধানিক নীতিকে এই ধারণাপত্রের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি ও শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তিকে একটি জাতির পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের চাবিকাঠি বলে মনে করে।

একটি শান্তিপূর্ণ ও সুরক্ষিত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠনের জন্য ’৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাংলাদেশের ঘোষণায় তা প্রতিভাত হয়। ভারত মহাসাগরকে ‘শান্তির অঞ্চল’ হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাপত্রের সঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাপত্রের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বহুপাক্ষিক সহযোগিতার বিস্তৃত সুযোগ সামনে এনেছে। এই অঞ্চলে সামগ্রিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য অর্থনীতি থেকে জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছে। এ ছাড়া আইপিও গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক সমাজে ‘শান্তির সংস্কৃতি’র ধারণা তুলে ধরেছে।

টেকসই উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের আইপিও গৃহীত হয়েছে। এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমস্যা এবং কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্তঃনির্ভরশীলতা ও আন্তঃসংযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করে। দ্বন্দ্ব, শত্রুতা ও অবিশ্বাস এড়াতে ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্যের নীতি বজায় রেখে চলে আসছে। একই সঙ্গে ধারণাপত্রটি এই অঞ্চলের সদস্যদের মধ্যে সর্বোচ্চ আস্থা ও বোঝাপড়া বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এই ধারণাপত্রটির মাধ্যমে বাংলাদেশের সামুদ্রিক প্রেক্ষাপট, সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে ইন্দো-প্যাসিফিকে আঞ্চলিক সংহতি বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরির কথা বলা হয়েছে।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইইউ এবং আসিয়ানসহ বেশ কিছু দেশ ও গ্রুপ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারণা প্রকাশ করেছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের রূপরেখাগুলো এ অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি সঞ্চয়ের ওপর জোর দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আইপিও উন্মোচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জানান দিয়েছে যে, তারও একটি নিজস্ব কণ্ঠস্বর ও পরিকল্পনা রয়েছে। চল্লিশটি বৃহৎ, প্রধান, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ক্ষমতার দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান মাঝারি শক্তির রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও দর্শন রয়েছে।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ কিংবা ভারত, এমন কোনো বৃহৎ শক্তির বয়ান অনুসরণের পরিবর্তে ইন্দো-প্যাসিফিককে ঘিরে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছে এবং নিজস্ব পরিকল্পনা ও কৌশলের প্রতি মনোযোগী হয়েছে। এর মাধ্যমে সংকীর্ণ ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশ নিজেকে দূরে রাখতে পারে। এ ছাড়া কোনো জাতিকে হুমকি হিসেবে দেখানো যেতে পারে, এমন কৌশলগুলো আইপিওতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সামরিকায়ন ও শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে এমন কোনো এজেন্ডা আইপিওতে স্থান পায়নি। সেই সঙ্গে প্রথাগত নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে বাংলাদেশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে এবং মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন নিরাপত্তা ইস্যুতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। সাম্প্রতিক ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তারসহ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো বাংলাদেশের এ ধারণাপত্রটিকে স্বাগত জানিয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে এই অঞ্চলের ছোট-বড় যেসব শক্তির মনে প্রশ্ন বা উদ্বেগ ছিল সদ্য প্রকাশিত বাংলাদেশের ধারণাপত্রটি তাদের জন্য মোক্ষম উত্তর হিসেবে হাজির হয়েছে। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়’Ñ পররাষ্ট্রনীতির এই মূলমন্ত্রের ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত রূপরেখাটির মাধ্যমে এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলার সুযোগ কার্যত দূর করেছে।

আব্দুল্লাহ সাদী : দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে পিএইচডি গবেষক, বস্টন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য