advertisement
advertisement
advertisement.

গাজীপুরে হেরে জিতেছে সরকার

মোস্তফা কামাল
২৭ মে ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৭ মে ২০২৩ ০৯:২১ এএম
advertisement..

বড় ক্রুশিয়েল সময়ে সম্পন্ন হলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা দিলে কেবল জড়িতদের নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা দেওয়া হবে নাÑ এমন একটি কঠিন ঘোষণার মাঝে হলো নির্বাচনটি। কদিন ধরে গুঞ্জন ছিল আরেকটি স্যাংশন আসছে বলে। স্যাংশন আসেনি। ভিসা রেস্ট্রিকশন এসেছে। কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম নয়। কারও ওপর শুধু ভিসা রেস্ট্রিকশন দিলে সে ওই দেশে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু কারও ওপর ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্টে স্যাংশন দিলে সে ওই দেশে ঢুকতে তো পারবেই না, সঙ্গে সঙ্গে ওই দেশে থাকা তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। তার ভিসা কার্ড এবং মাস্টার কার্ড এফিলিয়েটেড ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। এই দুই কার্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ যে কোনো দেশের কোনো ব্যাংকে সে অ্যাকাউন্ট রাখতে পারবে না। তার সারমর্ম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশে গেলেও তাকে ক্যাশ টাকা দিয়ে সব কাজ করতে হবে। অর্থাৎ ‘ভিসা রেস্ট্রিকশন’ আর ‘স্যাংশন’ এক জিনিস নয়। ভিসা দেওয়া না দেওয়া নিয়ে আমেরিকার হুমকির জেরে কিছুটা ছায়া পড়েছে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে।

মার্কিন নতুন ভিসানীতির জের বা তোলপাড়ের কারণে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ভেতরের ঘটনা অনেক তলিয়ে গেছে। গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষণ চলবে কদিন। স্থানীয় নির্বাচন হলেও সেখানে জাতীয় রাজনীতির পরাজয় দৃশ্যমান। এর পরও বলতে হবে গাজীপুরের পৌর নির্বাচনে গাজীপুরের মানুষের ইচ্ছা জয়ী হয়েছে। মানুষের পছন্দ বিজয়ী হয়েছে। একজন সাধারণ গৃহিণীর কাছে সিজনড পলিটিশিয়ানের পরাজয়কে সাদামাটাভাবে কিংবা নানা অজুহাত দিয়ে খাটো করার চেষ্টা করলেই বাস্তবতা ভিন্ন হয়ে যায় না, যাবে না। সরকার মনোনীত প্রার্থীকে গাজীপুরের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি সরকারের পরাজয়, আবার জয়ও হয়েছে। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক ব্যাখ্যা। সরকার নিশ্চয়ই সেই ব্যাখ্যা ও যুক্তির সুযোগটি হাতছাড়া করবে না। এ সরকারের আমলে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, নিজদলের জনপ্রিয় নেতাও হেরে যান সেই প্রশ্ন এখন সরকারের হাতে।

advertisement

এরই মধ্যে অনেকে রসিকতা করে বলতে শুরু করেছেন, গাজীপুরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিতেছে। হেরেছে সরকার। আর মাঝে দিয়ে কপাল পুড়েছে আওয়ামী লীগের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা বেচারা আজমত উল্লা খানের। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতিটি নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও সরকারকে এক চরম চাপে ফেলেছে। এ সময়টাতেই হলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কাগজ-কলমে এটি স্থানীয় নির্বাচন। কিন্তু সময় ও ঘটনাচক্রে হয়ে গেল জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও বেশি। এক ধরনের আন্তর্জাতিক নির্বাচন।

স্থানীয় বিবেচনায়ও নির্বাচনটি নানা উপাদানে ভরা। ছেলে সাবেক মেয়র। ক্ষমতাসীন দল থেকে বহিষ্কৃত। বহু মামলার আসামি। তিনি বুদ্ধি করে দাঁড় করিয়ে দিলেন জীবনেও রাজনীতি না করা বৃদ্ধ মাকে। সেই মা এখন নগরমাতা, নগরদাদি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত। মা জায়েদা খাতুন গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। কথায় বড় টনে টনে। কথার খই ফোটানো যাকে বলে। ফলাফল ঘোষণার পর সাংবাদিকদের মাধ্যমে তার দলকে, দেশের মানুষকে জানালেন গাজীপুরে নৌকার জয় হয়েছে, পরাজয় হয়েছে ব্যক্তির। মাকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

ঢাকার উপকণ্ঠে গাজীপুর নানা কারণে আলোচিত। সেখানকার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদার কাছে হারলেন ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে। জায়েদার ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ভোটের লড়াইয়ের পুরোটা সময় মাঠে ছিলেন আজমত উল্লার বিপক্ষে, মায়ের পক্ষে। বড় কঠিন পরীক্ষায় ছিলেন তিনি। মায়ের পক্ষ, নিজের অস্তিত্ব, আজমত উল্লাকে হারানো, দলের বিশেষ একটি অংশকে হাতে রাখা, টাকার খেলাসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জে মাঠে থাকতে হয়েছে দিনরাত। অন্যরকম একটা ক্রেজ তুলতে হয়েছে তাকে। অন্যদিকে আজমত উল্লার মতো প্রবীণ-শিক্ষিত নেতা নির্বাচনী প্রচারে যা বলেছেন, এর প্রায় সবই ছিল জাহাঙ্গীরকেন্দ্রিক। তার বিরুদ্ধে হেন কথা নেই যা তাকে বলতে না হয়েছে। অথচ জীবনে কটুকথা বলার রেকর্ড ছিল না আজমত উল্লার। সেখানে নিজে নির্বাচন করতে না পারলেও গাজীপুরের একচ্ছত্র নেতা হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর বলেছেন, তিনি জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগার। আর এখানকার আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত ব্যক্তি। মাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন। গাজীপুরের উন্নয়নে মায়ের সঙ্গে থাকবেন সারাক্ষণ। ঘটনা ও পরিস্থিতি তাকে মুখপণ্ডিতও করে দিয়েছে। বুদ্ধির খেলা আরও খেলেছেন। আজমত উল্লাহ সম্পর্কে কোনো বাজে মন্তব্য করেননি। বরং বলেছেন, ‘আমার বড় ভাই আজমত উল্লা খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো রাগ, ক্ষোভ নেই।’

ভোটের ফলাফলে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। তৃতীয় হওয়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান ৪৫ হাজার ৩৫২ ভোট পেয়েছেন। অপর মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট ও হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।

জাহাঙ্গীরের প্রতি নেওয়া সরকারের পদক্ষেপকে গ্রহণ করেনি। বিরক্ত হয়েছে। সরকারের প্রতি এমনিতেই মানুষের বিরক্তি আছে। সেটা সরকার স্বীকার করতে চান না হয়তো। যাচাই করতেও চান না। কিন্তু বাস্তবতা তো বাস্তবতাই। রাজনীতির পরাজয় দৃশ্যমান। নেপথ্যটা বড় করুণ। জাতীয় রাজনীতির জন্য অ্যালার্মিং। সরকারি দলের নমিনেশন পরিপক্ব ছিল কিনা, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আজমত উল্লার পক্ষে ছিলেন কিনা এসব প্রশ্ন আছে। তারা দলের প্রার্থীর পক্ষে থাকলে ফলাফল এমন হলো কেন এসব প্রশ্নও আছে। তাকি কেবল গাজীপুরে? নাকি সারাদেশের বেশিরভাগ এলাকার চিত্র? মানুষের মনের ব্যথা রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের উঁচুতলার নেতারা কি জানেন, বোঝেন? ঘটনা ঘটার আগে বুঝতে পারাটা পরিপক্বতা। পরে বুঝলেও অন্তত সামনের দিনগুলোর জন্য কিছু ভরসা থাকে।

নির্বাচন কমিশনের জন্যও গাজীপুর ছিল একটা পরীক্ষা। কিছুদিন ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলে আসছিলেন, সরকার সহযোগিতা না করলে বা সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এটি অবশ্যই তার বাস্তব উপলব্ধি। সরকারের আন্তরিকতার রকমফের জানা দরকার। বিশেষ করে গাজীপুরে সরকার তাকে কী রকম সহযোগিতা করেছে- এ জিজ্ঞাসাটি কিন্তু থেকে যাচ্ছে। তার এ সংক্রান্ত বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন। বলছেন, এটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়। পাশাপাশি এটি কিন্তু নির্বাচন কমিশনেরও বিষয়। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে ‘নিয়ন্ত্রিত’ পরিবেশে দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পরের জাতীয় নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ-বিতর্কিত। এবারও জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পাঁচ সিটির ভোট। যার শুরুটা হলো আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুর দিয়ে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, গুরুত্ব মিলিয়ে সামনে আরও কত বড় নির্বাচনী আয়োজন অপেক্ষমাণ। যা দেখার অপেক্ষায় কেবল দেশের মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বও।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন