advertisement
advertisement
advertisement.

আত্মবিরোধে ‘শান্তিবাদী’ হিরোশিমা

জেন ডারবি মেনটন
২৭ মে ২০২৩ ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৬ মে ২০২৩ ১১:৫২ পিএম
advertisement..

হিরোশিমায় পারমাণবিক হামলার পর ‘শান্তিবাদী’ প্রতিরক্ষানীতি গ্রহণ করে জাপান। পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী প্রচারাভিযানে হিরোশিমা হয়ে ওঠে বৈশি^ক প্রতীক। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের উত্থান, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি নিয়ে ‘সন্দেহ’ তৈরি হওয়ায় জাপান কতদিন পারমাণবিক অস্ত্র থেকে দূরে থাকতে পারবে, তা নিয়ে কথা উঠেছে। এ নিয়ে ফরেন পলিসি সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ করেছেন আমাদের সময়ের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক আসাদ লাবলু

‘হিরোশিমা, মোন আমর’ সিনেমার চিত্রনাট্যে ফরাসি লেখক মাগারিত দুহাস লিখেছেনÑ হিরোশিমাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র জায়গাÑ যেখানে জাতি, ইতিহাস, অর্থনীতি ও দর্শনের জায়গা থেকে আলাদা দুজন মানুষ নিজেদের একই বিন্দুতে মেলাতে পেরেছিলেন। পারমাণবিক বোমার প্রথম ঝলকানির সাক্ষী হয়ে থাকা হিরোশিমা নিয়ে এই ‘সর্বজনীন সত্য’ অবশ্য আরও অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৬ সালে হিরোশিমা পরিদর্শনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ওই হামলাকে ‘মানবতার আত্মবিরোধ’ হিসেবে মূল্যায়ন করে বলেছিলেন, আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি ও সক্ষমতা আমাদের ধ্বংসও করে দিতে পারে।

advertisement

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট; সকাল সোয়া ৮টায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বি-২৯’ বোমারু বিমান থেকে হিরোশিমার বুকে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, ওই হামলায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অবশ্য বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের মতে, নিহতের সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজারের কাছাকাছি। হিরোশিমার তিন দিন পর নাগাসাকিতে আরেকটি পারমাণবিক বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। ওই হামলায় মৃত্যু হয় ৪০ থেকে ৭০ হাজার মানুষের।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ১৯৪৫ সালের পর থেকে অন্তত ১ লাখ ২৫ হাজার পারমাণবিক বোমা বানানো হয়েছে। এসব বোমার বেশিরভাগই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার হাতে। যদিও গত ৭৮ বছরে আর কেউ এই অস্ত্র ব্যবহার করেনি। এর মানে হলো, হিরোশিমা ইতিহাসের এমন একটি অধ্যায়, যেখানে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা তত্ত্বের চেয়ে বেশি মূর্ত হয়ে উঠেছে।

পারমাণবিক হামলার শিকার হওয়া প্রথম শহর হিসেবে হিরোশিমা পর্যটকদের কাছে আলাদা আবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি মানুষ ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’, ‘চিলড্রেনস পিস মনুমেন্ট’ ও ‘জেনবাকু ডোম’ দেখতে শহরটিতে পা ফেলেন। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পাশাপাশি এ তালিকায় রয়েছেন জি-সেভেনের নেতারা।

এবারের জি-সেভেন সম্মেলন হিরোশিমায় করার প্রতীকী অর্থ মোটামুটি পরিষ্কার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পরমাণু অস্ত্র নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের হুমকি-ধমকিতে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা আশা করছেন, এবারের সম্মেলন পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ মোকাবিলার বিষয়ে বিশ^নেতাদের উৎসাহিত করবে। অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ ও সমালোচক মনে করছেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি কমানোর ব্যাপারে বিশ^নেতাদের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা পুনর্ব্যক্ত করতে এবারের সম্মেলনকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

এ সম্মেলন অবশ্য হিরোশিমার দ্বিচারিতাকেও সামনে এনেছে। ১৯৪৫ সালের পর পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের প্রচারাভিযানে একেবারে সামনের কাতারে অবস্থান নেয় হিরোশিমা; একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জাপানের সামরিকনির্ভরতা বাড়তে থাকে। তার পরও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের প্রচারাভিযানে হিরোশিমা যে প্রতীকী অর্থ বহন করে, তার সঙ্গে জাপানের ‘শান্তিপ্রিয়’ প্রতিরক্ষানীতির দূরত্ব খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না। আজ এসে যখন চীন ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে, চীন যখন পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার মজবুত করছে, তখন সেই দূরত্ব নতুন করে সামনে আসছে।

কিশিদার কাছে হিরোশিমার অনেক কিছুই জীবন্ত। হিরোশিমার সঙ্গে তার পরিবারের ইতিহাস জড়িত। পারমাণবিক বোমা হামলায় তিনি অনেক স্বজন হারিয়েছেন। তিনি এমন সব মানুষের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, যাদের অনেকেই পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছিলেন। এসব ঘটনার সবই একটা আলাদা প্রলেপ তৈরি করেছে কিশিদার রাজনৈতিক দর্শনে।

২০১৫ সালে পারমাণবিক বোমা হামলার ৭০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে বিশে^র অনেক ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কিশিদা। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার ক্ষত বিশ^বাসীর সামনে তুলে ধরাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। এ ছাড়া ২০১৬ সালে বারাক ওবামাকে হিরোশিমা সফরে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন জাপানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিশিদা। সেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন কোনো প্রেসিডেন্টের প্রথম হিরোশিমা সফর। ফলে পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের প্রতীক হিসেবে হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত এবারের জি-সেভেন সম্মেলন বৈশি^ক শান্তি প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু ‘শান্তিবাদী নীতি’কে কিশিদার রাজনৈতিক মূলমন্ত্র ধরে নিয়েও দেখা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এমন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো জাপানের শান্তিবাদী নীতিতে কিছুটা হলেও আঘাত করেছে।

কিশিদা ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির যে অংশের নেতৃত্ব দেন, সেটি তুলনামূলক বেশি ‘শান্তিবাদী’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাপানের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি এখন তাকেই দেখভাল করতে হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তিনি একটি নতুন জাতীয় নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা কৌশল সামনে আনেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। জাপানের সংবিধানে যুদ্ধকে ‘না’ বলা হলেও আগামী পাঁচ বছরে দেশটি সামরিক বরাদ্দ দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। অর্থাৎ সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে জাপানের অবস্থান থাকবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ মহাকাশ এবং সাইবার স্পেসেও শক্তি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে জাপান।

বৈশি^ক শান্তির যে বার্তা হিরোশিমা বহন করে, তার সঙ্গে জাপানের এসব প্রতিরক্ষানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অবশ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করলেও পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে জাপান আগের অবস্থানেই অনড় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিকে ঘিরে একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি উভয় দেশই ওয়াশিংটনের দেওয়া প্রতিশ্রুতির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। আবার পরমাণু অস্ত্র তৈরির কমবেশি সক্ষমতার আভাসও জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে এসেছে। অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অনেক রসদই তাদের কাছে রয়েছে; বিশেষ করে জাপানকে বিবেচনা করা হয় পারমাণবিক অস্ত্রের ‘দ্বারপ্রান্তে’ দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশ হিসেবে। জাপান পারমাণবিক চুল্লি থেকে ব্যয়িত জ্বালানি পুনরায় প্রক্রিয়াকরণ করে এবং এটিতে বিচ্ছিন্ন প্লুটোনিয়ামের একটি বিশাল মজুদ রয়েছে, যা একটি বোমার জন্য প্রয়োজনীয় বিচ্ছিন্ন পদার্থগুলোর মধ্যে একটি।

অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে কিনা, তা নিয়ে দেশটিতে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। চীনের উত্থান, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি নিয়ে ‘সন্দেহ’ তৈরি হওয়ায় মূলত এ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

জাপান অবশ্য এখনো পারমাণবিক অস্ত্রের বিরোধিতায় অনড় রয়েছে; যদিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেসহ কিছু রাজনীতিবিদ জাপানের পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী কঠোর নীতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিশিদার মধ্যে এখন পর্যন্ত সেই সংশয় দেখা যায়নি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির যে পরামর্শ আবে দিয়েছিলেন, সেটাই তিনি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পারমাণবিক অস্ত্রের ঝনঝনানি নিয়ে কিশিদার মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে জাপান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের পথে হাঁটে, তা হলে হিরোশিমার শান্তিবাদী দর্শন নিশ্চিতভাবেই আত্মবিরোধের মুখে পড়ে যাবে।

জেন ডারবি মেনটন : গবেষক; ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া