প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের একটি গবেষণায় এ বিষয়টি উঠে এসেছে। এখানে যে বিষয়টি বলা হচ্ছে তা হলো, শিল্প-কারখানাগুলোতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে। আগের চেয়ে শিল্পক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়াও এর একটি কারণ। এর ফলে দেশের শিল্প খাতে উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়লেও কর্মসংস্থান সেই হারে বাড়েনি। বরং এ ক্ষেত্রে মানুষের কাজের সুযোগ ক্রমেই কমে আসছে। গত দুই বছরে এ খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ছিল শূন্য শতাংশ। আর গত ২৬ বছরে এ খাতে প্রতি মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের বিপরীতে শ্রমিকের কর্মসংস্থান কমেছে ৭৪ শতাংশ। এটি যে শুধু বস্ত্র খাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, বরং সরকারের বাস্তব কর্মপরিকল্পনা, নীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সব ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নয়ন কোনোভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শিল্পক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যদি মানুষকে সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তেমনি প্রযুক্তিকে শিল্পক্ষেত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আবার মানবিক প্রগতির সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে প্রযুক্তির কারণে মানুষের শিল্পক্ষেত্রে অংশগ্রহণ কমলে তার প্রভাব সমাজের ওপর বিরূপভাবে পড়তে পারে। আবার মানুষের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নয়ন কমালে শিল্পের গুণগত মান ও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা সম্ভব নয়।
সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও মানুষ কি একে অন্যের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে, নাকি প্রযুক্তি ও মানুষকে সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো প্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নয়ন যেমন অব্যাহত রাখতে হবে, তেমনি দক্ষ মানবসম্পদের ব্যবহার ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। আবার প্রযুক্তির পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে মানুষ যাতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে পারে সে বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়েই হয়তো ভবিষ্যতে কল সেন্টার এবং গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মতো কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ হবে। ফলে এসব কাজে নিয়োজিত মধ্যম এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর লাখ লাখ কর্মী যে কর্মহীন হয়ে পড়বেন তার নোটিশ এখন আমাদের চোখের সামনেই। নিকট-ভবিষ্যতে হয়তো ক্লিনার কিংবা কলকারখানায় শ্রমিক লাগবে না। কিন্তু ক্লিনিং ও শিল্পের যন্ত্র তৈরি, উন্নয়ন ও অপারেশনে দক্ষ জনশক্তি লাগবে।
আগামী দশকের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অপরিহার্য অংশ হিসেবে আবির্ভূত হবে যে এআইয়ের ব্যবহার ছাড়া আমরা একদিনও হয়তো চলতে পারব না। স্বাস্থ্যসেবা, জটিল অস্ত্রোপচার কিংবা বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তথ্য বিশ্লেষণ করে জটিল সিদ্ধান্ত দেওয়া, শিল্পদ্রব্যের ডিজাইন ও উৎপাদন, গ্রাহকসেবা, ব্যাংকিং ইত্যাদিতে এ নতুন প্রযুক্তি হয়ে উঠবে সুস্পষ্ট ও সর্বব্যাপী।
প্রতিটি দেশের ও প্রতিষ্ঠানের উচিত প্রযুক্তিটির অপব্যবহার রোধে দ্রুত আইন ও নীতিমালা তৈরি করা। ফিউচার টুডে ইনস্টিটিউটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মেলানি সুবিন বলেন, এআই প্রযুক্তির রক্ষণাবেক্ষণে যে নীতিমালা দরকার, সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেই। স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে ইলোন মাস্ক-বিশ্বের শীর্ষ কয়েকজন বিজ্ঞানী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এটি এক সময় হয়তো মানব প্রজাতির জন্য একটি হুমকি হয়ে উঠবে, বিরূপ প্রভাব ফেলবে জাতীয় অর্থনীতিতে। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আঙুলের স্পর্শ ছাড়াই ভয়েসের মাধ্যমে ইচ্ছামতো অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করা যায়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক ড্রাইভারলেস কার বা গাড়িতে ব্যবহৃত অটো পাইলট ব্যাপারটাও সম্পূর্ণ এআই। বর্তমানে শিল্প-কারখানাগুলোয় ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতিতেও এআই ইমপ্লান্ট করা হচ্ছে। অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট, আলিবাবা, অ্যাপলসহ বড় বড় সব টেক জায়ান্টও প্রচুর পরিমাণে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে এবং এর সম্ভাব্য সব সংস্করণ ও উন্নতি করছে। এ হিসেবে বলা যায়, ভবিষ্যৎ পৃথিবী অবশ্যই এআই নির্ভর হবে এবং এ প্রযুক্তি কতটা নিরাপদ হবে তা নির্ভর করছে আমাদের চিন্তাধারা ও এর ব্যবহারের ওপর। তবে শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণেই বেকারত্ব বাড়ছে এমনটি নয়। নতুন এ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারাটাও অনেকটা দায়ী। তাই আগামী দিনগুলোয় আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হবে নতুন প্রযুক্তি উপযোগী পরিবেশ ও প্রস্তুতি তৈরি করে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। পাশাপাশি এর পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা ও ক্ষমতা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও ব্যবসাবান্ধব উন্নত পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই এআইয়ের সঠিক উদ্ভাবন, ব্যবহার এবং সময়োপযোগী উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ আগাম প্রস্তুতি না থাকলে প্রযুক্তি পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বেকারত্ব আগামী দিনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
রায়হান আহমেদ : গবেষক ও কলাম লেখক