বরিশাল সিটি নির্বাচন
ষড়যন্ত্রের অংশ আখ্যা দিয়ে আপন বড় ভাই বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে গৌরনদীতে গতকাল অনুষ্ঠিত জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিতসভায় অংশ নেননি ছোট ভাই ও বরিশাল সিটি করপোরেশন (বসিক) নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ও তার সমর্থক নেতারা।
হাসনাত সমর্থক নেতাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতকে তার সমর্থক নেতারা গতকাল সারাদিন তাকে কৌশলে নগরীতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যস্ত রাখেন।
বর্ধিতসভা সূত্রে জানা যায়, গত ২১ মে বিকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে বৈঠক করেন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয়
নেতারা। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকালের বর্ধিতসভায় অংশ নেন বরিশালের পাঁচ সংসদ সদস্য এবং জেলা-মহানগর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সকল সদস্য। শুধু ছিলেন না সভার মধ্যমণি খোকন সেরনিসয়াবাত। এর মধ্য দিয়ে আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিরাজমান দ্বন্দ্ব আরও পোক্ত হলো বলে মনে করছেন দলীয় নেতাদের অনেকে। এর ফলে ভোটের মাঠে অনাকাক্সিক্ষত বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে নৌকার প্রার্থীকে। যে বিরোধিতার পেছনে থাকবে আওয়ামী লীগেরই বড় একটি অংশ। যেমনটি ঘটেছিল প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরনের দ্বিতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
গত ১৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ড বরিশালের মেয়র পদে খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দেয়। তখন বর্তমান মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ ও তার বাবা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ অনেকটা চুপ ছিলেন। তিন দিন পর ভার্চুয়ালি একটি সভায় যোগ দিয়ে বরিশাল নগরের সব নেতাকর্মীকে চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে মাঠে কাজ করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু মুখ খুলেননি তার বাবা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে অব্যাহত সংবাদ প্রচারে টনক নড়ে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর। গত ২১ মে বিকালে তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দক্ষিণাঞ্চলের অভিভাবক খ্যাত নেতা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ছেলে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় এক মাস ঢাকায় চুপচাপ ছিলেন। দলের কঠোর অবস্থানের কারণে তিনি নেতাকর্মীদের নির্বাচনী দিকনির্দেশনামূলক বর্ধিতসভার আয়োজন করেন। কিন্তু ওই সভায় উপস্থিত হননি মেয়র প্রার্থী খোকন। সূত্রটির দাবি, এক মাস পর হাসনাত বরিশাল শহর থেকে একশ কিলোমিটার দূরে সভার আয়োজন করে মূলত মেয়র প্রার্থী খোকনের একটি দিনের নির্বাচনী কর্মকা- ব্যাহত করতে চেয়েছেন।
খোকনের পক্ষের নেতারা মনে করেন, গতকাল ছিল প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দের নির্ধারিত দিন। তাছাড়া বরিশালে তার পূর্বনির্ধারিত তিনটি কর্মসূচি ছিল। মূলত এসব কর্মসূচিতে খোকন যাতে অংশ নিতে না পারেন সেজন্য হাসনাত আবদুল্লাহ কৌশলে বর্ধিতসভা ডাকেন। কিন্তু এ ব্যাপারে গতকাল জানতে চাইলে খোকন সেরনিয়াবাত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি থাকায় বর্ধিতসভায় যেতে পারেননি।
দলীয় অপর একটি সূত্র জানায়, মূলত বর্ধিতসভার তারিখ ঘোষণার পর একই দিনে নগরীতে তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন খোকন সেরনিয়াবাত। সভায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে নিশ্চয়ই তা করতেন না।
নৌকা প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন বলেন, বর্ধিতসভায় যোগ দেওয়া, না দেওয়া প্রার্থীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। শুক্রবার পূর্বনির্ধারিত প্রতীক বরাদ্দ ছাড়াও বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ছিল। আর সভার আয়োজনস্থল বরিশাল শহর থেকে একশ কিলোমিটার দূরে।
দলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্ট বিভেদ দূর করে সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার শেষ সুযোগ ছিল গতকাল শুক্রবার। এর মধ্য দিয়ে দূরত্ব অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু খোকন সভায় যোগ না দেওয়ায় সেই সুযোগটিও হাতছাড়া হয়েছে। এখন আর খোকন দলের বড় একটি অংশকে পাশে পাবেন না।
খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দিন মোহন বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নতুন সিদ্ধান্তে বরিশালে নৌকার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যারা এতদিন শহরটাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল, তাদের ভয় পায় মানুষ। তারা নৌকার পক্ষে কাজ করলে আমাদের থেকেও মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ কারণে আমরা তাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছি না। আমরাও তাদের ডাকছি না।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে আমাদের রাখা না হলেও আমরা নির্বাচনী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা সকলেই নৌকার কর্মী। তিনি আরও বলেন, আমাদের অভিভাবক আজকে সভা করেছেন। সেখানে অংশ না নিয়ে খোকন সেরনিয়াবাত ভুল করেছেন। তাকে কিছু লোক (খলিফা) আগলে রাখায় তিনি ভাই-ভাতিজাসহ প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে দূরে আছেন বলে মন্তব্য জাহাঙ্গীরের।
এদিকে গতকাল গৌরনদী পৌরসভা মাঠে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিতসভায় সভাপতির বক্তব্যে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এমপি বলেছেন, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়ে কিছু নেতাকর্মীর মনে যদি কোনো আবেগ বা কষ্ট থেকেও থাকে, তাহলে দলের স্বার্থে, মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্তের স্বার্থে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বার্থে আমার ছোট ভাই খোকন সেরনিয়াবাতকে বিজয়ী করতে সবকিছু ভুলে যান। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী করতে মাঠে কাজ করার আহ্বান জানান।
হাসনাত আরও বলেন, এখানে আমার ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র ছিলেন, তার কিছু অনুসারী আছে। তাদের মনে কষ্ট আছে। তা ভুলে যেতে হবে। তিনি তার (হাসনাত) অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সিটি নির্বাচনে জয়ী হতে উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানান।
সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ. ফ. ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আনিসুর রহমান ও মো. গোলাম কবীর রাব্বানী চিনু, বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম, বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ, বরিশাল-৫ আসনের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম ও সংরক্ষিত সংসদ সদস্য সৈয়দা রুবিনা আক্তার, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস প্রমুখ।